Wednesday, September 5, 2012

সহস্রাব্দ পুরস্কার সমস্যা


সহস্রাব্দ পুরস্কার সমস্যা
-সুব্রত মজুমদার


বিশ্বের মনীষী দের ব্যাপক পরিচিতি ও সমাদৃতির প্রসঙ্গে নোবেল পুরস্কার সাহিত্য ও বিজ্ঞান সহ কয়েকটি ক্ষেত্রে বর্তমানে সব চেয়ে উঁচু মানের বলে বিবেচিত হয় | এর সঙ্গে প্রদত্ত অর্থের পরিমান অন্য পুরস্কারের তুলনায় বেশি | গণিতে নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই | কিন্তু নতুন শতাব্দীর শুরুতে (Clay Mathematics Institute প্যারিসের College de France -এ একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, ২৪ মে ২০০০) গণিতের সাত-টি অমীমাংসিত, মৌলিক এবং অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের জন্যে বিশ্ববাসীর কাছে বিরাট অঙ্কের পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন | বিংশ শতাব্দীতে এগুলি কঠিন অথচ গুরুত্বের জন্যে সব চেয়ে আকর্ষনীয় ছিল, এবং গণিতের ইতিহাসে সব চেয়ে বেশি সংখ্যায় শ্রেষ্ঠতম গণিতবিদরা এই সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি | এগুলির মীমাংসা হওয়া গণিতের ভবিষ্যত বিকাশের জন্যে অত্যন্ত মূল্যবান |

মাইকেল আতিয়া ও জন টেট, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দুজন গণিতবিদ ২৪ মে ২০০০ তারিখে Clay Mathematics Institute -র পক্ষে পুরস্কারের ঘোষণা দেন | এর মধ্যে  সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞদের বেশ কয়েক জন উপস্থিত ছিলেন | ৯৫ বছর বয়স্ক এঁরি কর্তা ও ফর্মা উপপাদ্য প্রমাণের কৃতিত্বের অধিকারী ইয়ান্দ্রু ওয়াইলস এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন |   সময় হিসেবে ২০০০ সাল ও স্থান হিসেবে প্যারিসকে নির্বাচন করার বিশেষ কারণ এই যে, ঠিক এর একশ বছর আগে গণিত সংঘ (IMU) আয়োজিত চতুর্বার্ষিক সম্মেলন (ICM ) ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেখানে পৃথিবীর সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের অন্যতম ডেভিড হিলবার্ট সকল গণিতবিদের সামনে তেইশটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তুলে ধরেন, যার সমাধান বিংশ শতাব্দীর গণিতচর্চাকে বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে সাহায্য করেছে |

গণিতের যে সাতটি সমস্যা সমাধানের জন্যে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানানো হয়েছে, তাদের নাম দেয়া হয়েছে `সহস্রাব্দ পুরস্কার সমস্যা' (Millenium Prize Problems) | এর প্রত্যেকটির সমাধানের জন্যে দশ লক্ষ্ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে |

পুরস্কারের জন্যে নির্বাচিত সমস্যাগুলি নিচে দেওয়া হলো:

(১) `P NP বিরোধিতা সমস্যা' (P versus NP Problem): কোনো সমস্যাকে P -এর অন্তর্গত বলা হবে, যদি এটি এমন পদ্ধতিতে সমাধান করা যায় যার জন্যে ব্যয়িত সময়টি বহুপদী প্রকৃতির (অর্থাত, ব্যয়িত সময় খুব বেশি হলে অন্তর্ভুক্তি সময়ের পরিমানের একটি বহুপদী ফাংশন হবে) | কোনো সমস্যাকে NP-র অন্তর্ভুক্ত বলা হবে, যদি এর সব প্রস্তাবিত সমাধানের নির্ভুলতা বহুপদী সময়ে নির্ণয় করা যায় | সমস্যা: P = NP ?

(২) রীমানের অনুমান (The Riemann Hypothesis ) : রীমান জিটা ফাংশনের প্রত্যেক অ-তুচ্ছ সমাধানের বাস্তব অংশ ১/২ হবে | এটির সত্যতা বা অসত্যতা প্রমাণ করতে হবে |

(৩) পোয়াকাঁরে অনুমান (The Poincare Conjecture ):  প্রত্যেক বদ্ধ সরল-সংযুক্ত ও-myanifold ত্রিমাত্রিক গোলকের সঙ্গে সমচিত্রক | এটি সত্য না অসত্য প্রমাণ করতে হবে |

(৪) হজ অনুমান (The Hodge Conjecture ): প্রত্যেক বিপরীত-বিশিষ্ট জটিল অভিক্ষেপী বীজগাণিতিক সমীকরণ-জাত জগতে প্রত্যেক হজ-গোষ্ঠী বীজগাণিতিক চক্রের গোষ্ঠীর মূলদ যোগাশ্রয়-লব্ধ সমাহার |

(৫) বার্চ ও সুইনার্টক-ডায়ার অনুমান  (Birch and Swinherton - Dyer Conjecture ): মূলদ ফিল্ডের ওপর বর্ণিত প্রত্যেক উপবৃত্তিক রেখার ক্ষেত্রে , ১-এ এর L-ফাংশনের শুন্য হবার মাত্রা রেখাটির মূলদ বিন্দুদের আবেলীয় গ্রুপের মাত্রার সমান | এর সত্যতা বা অসত্যতা প্রমাণ করতে হবে |

(৬) নেভিয়ার- স্টকস সমীকরনগুচ্ছ (The Navier-Stokes Equations) :  ত্রিমাত্রিক নেভিয়ার- স্টকস সমীকরনগুচ্ছের সমাধানের অস্তিত্ব ও মসৃণতার সত্যতা অথবা অসত্যতা প্রমাণ |

(৭) ইয়ং - মিলস সমীকরনগুচ্ছ (The Young Mills Equations): প্রমান কর যে কোয়ান্টাম  ইয়ং - মিলস ক্ষেত্রের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং এর ভর-বিচ্ছিন্নতা বিদ্যমান |

এই সমস্যাগুলি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ Clay Mathematical Institute এর website http://www.claymath.org/ এ পাওয়া যাবে |

আরো একটি দশ লক্ষ ডলার পুরস্কার:

এই সহস্রাব্দ পুরস্কার প্রতিযোগিতা ছাড়া আরেকটি দশ লক্ষ্য মার্কিন ডলারের পুরস্কার রয়েছে -- বিখ্যাত গোল্ডব্যাক অনুমান (The Goldman Conjecture) -এর সত্যতা বা অসত্যতা প্রমাণের জন্যে | এটা দেবেন Apostolos Doxiadis -এর লেখা Uncle Petros and Goldbach 's Conjecture বই এর প্রকাশক (Bloomsbury Publishers , US ও Faber and Faber Limited , UK )|

গোল্ডব্যাক অনুমান: ৪-এর বড় প্রত্যেক জোড় পুর্ণ  সংখ্যাকে দুটি বিজোড় মৌলিক সংখ্যার যোগফল হিসেবে লেখা যাবে |


সূত্র: Notices of the American Mathematical Society, September 2000

Saturday, August 4, 2012

Cultural Activities in Rajshahi University

Cultural Activities in Rajshahi University
-Professor Subrata Majumdar

Rajshahi has a long and glorious tradition in education and culture. About a thousand years ago this region was well known in South East Asia as a center for intellectual and cultural activities. During the first quarter of the last century, the fame of Rajshahi college (with post-graduate teaching facilities) as one of the best institutions of Bengal, the establishment of Varendra Research Museum as a center of research and of  Promoda Nath Town Hall as a center of cultural activities played a significant role in cultural development of the town. Quite a number of people with talent and vigorous training in music and drama kept up the reputation of the region. They include Haripada Das, Mozammel Hossain, Abdul Jabbar, Abdul Aziz Bachchu, Amaresh Roy Chowdhury, Manjusree Roy, Rabiul Hossain as classical vocalists, Raghu Nath Das (violin), Shib Nath Das (flute), Lakshmi Kanta Dey (sitar), Sarada Kinkar Majumdar (tabla) and Yasin Ali (tabla) as instrumentalists, Monu Master, Bozlar Rahman Badal and Hasiful Hossain Panna as dance artists, Sharmili Ahmed as an actress, Runa Laila, Andrew Kishore, Rafiqul Alam, Sarwar Jahan and Laisa Ahmed Lisa as singers. They are of course many others.

Established in the early fifties, Rajshahi University had an obligation to keep up the standard of cultural performance. It was difficult at the beginning.There were no residential halls and auditorium. Cultural programs were arranged occasionally. Teachers and students participated. The quality was not bad, but the credit was always individual. Once a play was staged jointly by teachers and students. Cultural competitions and sometimes inter-college competitions were held.

In late sixties, cultural activities were to become part and parcel of the social movement for the enlightenment of the masses regarding the continuity of the age-old tradition of Bengali culture of which Rabindranath Tagore and Kazi Nazrul Islam were very significant milestones in teh last 150 years. Pakistani rulers in their attempt to impose the so-called two-nation theory on the Bengali people endeavored to crush Bengali culture. The language movement leading to consequent martyrdom was the first severe opposition to this heinous plot. This acted as a seed which germinated into a complex of manifold activities highlighting the importance of conserving one's own cultural identity, together with respecting and accepting finer elements from other rich sources. The rulers tried to ban Tagore songs (songs which are superb in quality and eternal in their message) and to tailor Nazrul's broad-minded, liberal and humanist work to suit their communal outlook. But this resulted in drawing people closer to these geniuses. Rajshahi University was no exception.

During the political turmoil under the military regime in 1961, a cultural group of students was formed by teacher of the University Ghulam Murshid, Shishir Kumar Bhattacharjee and the author. It was named 'Sundaram', specialized on Tagore songs and performed in a number of occasions musical programs based on Tagore's seasonal songs. Tagore not only describes Nature, but feels the distinct mood and the spirit of each season and his songs are their embodiment.

Tagore's dance drama 'Shyama' was staged in 1970 and an audio version of the musical drama 'Shaap Mochan' was performed in early 1971 by students of the university under the direction of the present author. The main singers in these programs as well as in the programs by 'Sundaram' were Rafiqul Alam, Nargis Parveen, Deepa Banerjee, Amirul Huda, Tanzima Hoque.

During the liberation war of Bangladesh, there was a complete blackout of cultural activities in the campus. But soon after the victory  on December 1971, vigorous activities were resumed. A student Nurul Islam, organized a club called 'Shurjo Shishu' for which he built up a small library and arranged regular musical training for children under Haripada Das and Uma Majumdar. Ghulam Murshid trained a few universities students and a few campus girls for about three years. Among the trainees Laisa Ahmed Lisa and Sultana Shabnam Suman have earned fame. A number of dance dramas and musical dramas of Tagore were staged from the seventies through the nineties. These include 'Mayar Khela' (twice), 'Shyama', 'Tasher Desh' (twice), 'Boshsonto', "Shaap Mochan' (twice), Chondalika, 'Khomite Parilam Na' (a modified version of 'Shyama'). Those who participated in the main musical roles include Swapan Dutta, Sarwar Jahan, Rafiqul Alam, Sufi Asmar Ali, Rashidul Hoque, Krishna Debnath, Nanda Bhattacharjee, Nadira Begum, Kabita Majumdar, Laisa Ahmed Lisa, Imtiaz Ahmed, Sultana Shabnam Suman, Sarwar Murshed, Shaouli Shahid Tumpa, Sharmin Ara Kushum, Anandamayee Majumdar. In these dance dramas, G. A Mannan, Monu Master and Hasiful Hossain Panna performed the choreography. Panna acted in the major male roles in some of these dance dramas. The author directed the musical parts of the above performances. Hasan Azizul Hoque, Shishir Kumar Bhattacharjee, Azam Shantonu, Shantona Bhattacharya, Nazim Mahmud either took part, edited or assisted in these dramas.

In 1977, Ali Anwar organized a drama workshop for  the students. Nazim Mahmud, Ghulam Murshid, Golam Mostafa and others assisted him. A number of plays were staged in the early eighties and the late nineties by the teacher-officer club under the direction of Ali Anwar, Nazim Mahmud, Hasan Azizul Hoque and Malay Bhowmik. The teachers, officers and their relatives who participated in these plays include Shishir Kumar Bhattacharjee, Zillur Rahim, Basu Deb Das, Dilip Kumar Nath, Nurul Islam Chowdhury, Mukhlesur Rahman, Poly Islam, Runu Razzak and the above directors. Sanath Kumar Saha often assisted the actors and directors.

The ladies club of the university organized on Tagore and Nazrul every year.

Students Cultural Groups
The administration in the university and the country as a whole was not in favour of liberal cultural activities during 1975 through 1995. This acted as an impetus for the students to cultural groups to fight social and political injustice and focus the inconsistencies of the fundamentalist and conservative forces with cultural programs for ting from universal progress. Starting from 1979 quite a number of groups emerged. Of these, Onusheelon, Shomokaal, Rajshahi University Drama Association (RUDA), Teerthok, University Theatre of Rajshahi are groups fully devoted to drama. Each of these have 15-40 productions to their credit. Some of the plays are performed on stage, while some are open-air performances. Onusheelon is the oldest and has earned wide national reputation. Udichi Shilpi Goshthee Rajshahi University Council, and Oikotan are groups with multidimensional activities. Gonoshilpi shongstha, Oroni, Onirban, Nandon (now non-existent), Sheelon (now non-existent), Bongobondhu Shangshkritik Jot specialize in music and musical drama. Adibashi Students Association of Rajshahi University lays emphasis on adibashee culture.

Shwanon is a unique group specializing on poetry. Udichi has three clear branches specializing in music, drama and poetry. It performed considerable social work during the 1998 flood in Rajshahi. Teachers associated with the above groups include Moloy Bhowmik, S. M. Abu Bakar, Mizanuddin, Arefin Matin, Shafiqun-nabi Samadi, Shafiqul Islam, Masud Chowdhury. Rajshahi University Debating Society, Naree Progotee, Rajshahi University Shongbadpotro Pathok Forum, Muktijuddho Shangshkritik Forum are a few other groups. Muktijuddho Chorcha Kendro has the central objective of devoting itself to cultural activities enshrining the glorious spirit of the liberation war and leading the younger generation towards the fulfillment of the dreams of the freedom fighters. Jatiyotabadee Shamajik Shangshkritik Shongstha strives to preach 'Bangladeshi nationalism' contrary to the age-old Bengali tradition cherished and cultivated by the common people. Bikolpo is a fundamentalist group opposed to the very sentiments leading to the independence of Bangladesh. Rangon trains students in handicrafts and is commercially oriented.

TSCC
After a long struggle of the cultural groups in the 80's for a center which would coordinate the cultural activities and provide proper facilities to the groups for their perfection, arrange national and international seminars and which has use of modern technical gadget, provision of an auditorium with perfect light and sound systems, creation of a Teachers Student Cultural Center was approved by the University authority. A director was appointed with skeleton staff to start activities. At the moment there are three instructors to help the director in training students and organizing competition and cultural programs on important occasions. Nazim Mahmud, Omar Faruq, Nazrul Islam and Sarwar Jahan were the previous directors. Of them, Nazim Mahmud and Sarwar Jahan were exceptionally gifted in several cultural aspects.

Trophies and Prizes won
We are very happy that for the last two years our students have displayed high standards in cultural competitions at both national and international levels. The team sent to participate in SARC countries competition held in India in 1998 won two first prizes and one second prize. Every year the ministry of education organizes a national competition in education and culture on the occasion of National Education Week. Recently, the universities have been included in this program. At the national level, our students won four gold, two silver, two bronze medals in 2000, and four gold, two silver and four bronze medals in 2001. The total number of items were 14. The first Bangladesh inter-university cultural competition was held in July 2000 at the Rajshahi University campus. We came out as a champion with 8 first, 3 second and 2 third prizes in 15 items.

We hope the standards of performance will not only be kept up but further improved  through individual efforts and through TSCC assistance.

Although there is a plan to set up a TSCC complex with and auditorium and otere facilities for the proper noursihment of cultural talents, only a small part of the building has been completed. The size of the office-staff too is not big enough for arranging varied programs that are expected of this center. But we are optimistic that the day is not too far when the center will function to the satisfaction of all to whom cultural excellence is dear.


-Published in The Guardian while the author was Director to the Teachers Students Cultural Center of Rajshahi University (2001)





Sunday, August 15, 2010

কয়েকটি অসামান্য বাঙালী গণিত-প্রতিভা

কয়েকটি অসামান্য বাঙালী গণিত-প্রতিভা
-সুব্রত মজুমদার

`What Bengal thinks today will India think tomorrow' -- শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ও বাঙালীর অগ্রবর্তিতা সম্পর্কে মহামতি গোখলের এই উক্তি সে-যুগে ভারতের গণিতচর্চার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য | পাশ্চাত্য শিক্ষা সূচনার পর ভারতবর্ষে প্রথম গণিত-শিক্ষায় বিশ্বমানের সাফল্য, এবং বিশ্ব-মানের গণিত গবেষনার কৃতিত্ব বাঙালীর | এই পথিকৃত্-দের প্রায় অব্যবহিত পরেই অন্তত তিনজন বাঙালী গণিত ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন|

প্রাচীন কালে যে সব দেশ গণিত-চর্চায় অনেক উন্নতি করেছিল, তার মধ্যে অবিভক্ত ভারতবর্ষ অন্যতম | মধ্যযুগেও, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য প্রমুখ, এই উপমহাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন | এ-যুগের `শুন্য'-র আবিষ্কার ও ব্যবহার বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবীয় বৈজ্ঞানিকরা অবগত হন | এবং পরে তাঁদের মাধ্যমে ইউরোপে এই ধারণার প্রসার ঘটে -- গণিত ও বিজ্ঞানের জগতে এর ফলে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে | এসব সময় অবশ্য কোনো বাঙালীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়না | তাই গণিতে বাঙালীর প্রথম শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব-অর্জনের কৃতিত্ব উল্লিখিত ঊনবিংশ শতাব্দীর ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদের কয়েকজন মনীষীর | এঁদের কয়েকজন সম্পর্কে এখানে কিছু লিখব |

ভারতবর্ষ এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত থাকায়ব্রিটিশ আমলেই এখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটে, ফলে বৃটেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডে পড়াশুনো করে পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করা এবং ইংল্যান্ডের Royal Society-র Fellow (F.R.S) হওয়া শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন বলে আমরা স্বীকার করি | আন্তর্জাতিক ভাবে সমস্ত পৃথিবীতেই এই সবের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত | যে-গণিতবিদদের সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করব, তাঁদের বেলায়ও এই সব মাপকাঠি আমরা ব্যবহার করব |

বিলাতের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পরীক্ষায় (Mathematical Tripos প্রথম দুই Part) First Class পেলে পরীক্ষার্থীকে Wrangler বলা হয় | বিশেষ কৃতিত্ব হিসেবে সর্বত্র এর স্বীকৃতি রয়েছে | এই উপমহাদেশের প্রথম Wrangler বাঙালী আনন্দমোহন বসু | এঁর জন্ম ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মৃত্যু ১৯০৬ সালের ২০ অগাস্ট | জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার) জয়সিদ্ধি গ্রামে | অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী আনন্দমোহন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৬২ সালে প্রবেশিকা প­রীক্ষায় নবম হন | এর পরে এফ. এ. , বি. এ., ও গণিতে এম. এ. পরীক্ষার প্রত্যেকটিতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন | এর পর তিনি প্রেম চাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি অর্জন করেন এবং বিলাতে যাবার জন্য দশ হাজার টাকা বৃত্তিলাভ করে কেমব্রিজে ক্রাইস্ট-চার্চ কলেজে ভর্তি হন | ১৮৭৪ সালে তিনি Wrangler হন | এই পরীক্ষায় তাঁর প্রথম হয়ে Senior Wrangler হওয়ার ইচ্ছা ছিল, এবং সম্ভবত সামর্থ্যও ছিল | কিন্তু সেটি ঘটেনি | তার অন্যতম কারণ এই যে তিনি একই সঙ্গে ব্যারিস্টারী পরীক্ষা দেন, এবং ব্যারিস্টার হন | পরবর্তী জীবনে আনন্দমোহন অবশ্য গণিত-চর্চা বা গণিতে অধ্যাপনা করেননি -- তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন |

শিক্ষা-বিস্তারে আনন্দমোহনের বিশেষ উত্সাহ ও অবদান ছিল | তিনি নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি এই উদ্দেশে দান করেন | এটি এখনকার সিটি স্কুল | তাঁর শিক্ষা-বিস্তারের এই উদ্যোগের ফলশ্রুতি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ | এটি প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তাগাছার মহারাজা শশীকান্ত, রামগোপালপুরের জগকিশোর রায়চৌধুরী, সন্তোষের জমিদার রানী দিনমণি, মুক্তাগাছার জগত-কিশোর আচার্য্য, সন্তোষের প্রমথনাথ চৌধুরী, পুঁটিয়ার হেমন্তকুমারী দেবী এবং ভবানীপুর জমিদার-পত্নী রামসুন্দর দেবী অর্থ-সাহায্য দিয়েছিলেন |

আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর বোনের সঙ্গে আনন্দমোহনের বিয়ে হয় | তিনি কেশব চন্দ্র সেনের কাছে সস্ত্রীক ব্রাহ্ম-ধর্মে দীক্ষিত হন | ১৮৭৮ সালে তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন | তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি |

বঙ্গ-ভঙ্গ রোধের জন্য যে সম্মেলন হয়, অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করেন, এবং সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্ব শায়িত অবস্থায় পালন করেন | সেদিন তার রচিত প্রতিষ্ঠা-পত্র রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শুনিয়েছিলেন | বিলাতে বা ইউরোপ, আমেরিকার মত উন্নত কোনো দেশে না গিয়ে এবং সেখানকার পন্ডিতদের সহায়তা না নিয়ে ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে একান্ত নিজের মেধায় ও শক্তিতে বিশ্ব-গণিতের সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন যে উজ্জ্বল প্রতিভা, তাঁর নাম আশুতোষ মুখোপাধ্যায় | ১৮৬৪ সালে ১৮ জুন কলকাতায় এই মনীষীর জন্ম | ইনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় ও এফ. এ. তে তৃতীয় হন| এফ. এ. পরীক্ষার সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন | এফ. এ. অধ্যয়নকালে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (আচার্য্য), হেরম্ব মৈত্র, নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ) তাঁর সহপাঠী ছিলেন | তিনি বি. এ. পরীক্ষায় এ. কোর্স ও বি. কোর্স দুভাগ মিলিয়ে প্রথম হন এবং গণিতে এম. এ. পরীক্ষায়ও প্রথম হন | এর পরের বছর আশুতোষ গণিতে প্রেম চাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি পরীক্ষা ও বিজ্ঞানে এম. এ. পাশ করেন | প্রেম চাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বর এবং বিজ্ঞানে শতকরা ছিয়ানব্বই নম্বর পান | এই কৃতিত্বের জন্যে পরের বছরই তাঁকে গণিতের পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় | ১৮৮৮ সালে আশুতোষ ল (Law) পরীক্ষায় পাশ করেন এবং তার ছয় বছর পরে ডক্টর অফ ল ডিগ্রী অর্জন করেন | কিছু কালের জন্য তিনি Tagore Law Professor ছিলেন | আনন্দমোহন বোস তাঁর অন্যতম আইনের শিক্ষক ছিলেন | তাঁর মাত্র ষোলো বছর বয়েসের সময় Cambridge Messenger of Mathematics -এ তাঁর গণিতের প্রবন্ধ ছাপা হয় | এর পর ১০ বছরে এক এক করে তিনি কুড়িটি প্রবন্ধ লেখেন -- দেশের ও বিদেশের পত্রিকায় এগুলি ছাপা হয় | তখনকার দিনে বিলেতে যাবার ব্যাপারে হিন্দুদের মধ্যে নানারকম কুসংস্কার ছিল | এর ফলে, মায়ের আপত্তির কারণে আশুতোষের বিলাতে বা অন্যত্র উচ্চ-শিক্ষা বা গবেষণার জন্য যাওয়া হয়নি | তাই তাঁর সব গবেষণা ও আবিষ্কার দেশে বসে নিজে নিজেই করা | ১৮৮৪ সালে কলকাতার Journal of the Asiatic Society তে প্রকাশিত তাঁর একটি গবেষণাপত্র সম্পর্কে Joseph Edwards এর Differential Calculus বিষয়ক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে মন্তব্য আছে যে, বিখ্যাত গণিতবিদ Monge জ্যামিতির General Conic এর সমীকরণ থেকে সব কটি সহগ অপসারণের মাধ্যমে একটি Differential Equation পেয়েছিলেন | পৃথিবীবিখ্যাত গণিতবিদ এবং তত্কালীন London Mathematical Society র সভাপতি George Boole এই Differential Equation এর কোনো জ্যামিতিক তাত্পর্য খুঁজে পাননি | এবং পাওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন |এই Boole-এর নামে পরিচিত Boolean Algebra প্রায় সবার জ্ঞাত | আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে এই Differential Equation টি জ্যামিতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ | তিনি এর তাত্পর্য-ও পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছিলেন |

১৮৮৬ সালে বৃটেনের Quarterly Journal of Mathematics - এ আশুতোষের গবেষণা প্রবন্ধ ``A note on Elliptic Functions'' সম্বন্ধে বৃটেনের বিখ্যাত গণিতবিদ Cayley মন্তব্য করেন ``It is remarkable how in the forgoing investigation a real result is obtained by consideration of an imaginary point."

Enneper - Muller এর জার্মান বই Elliptichen Functionen এবং Broit et Broquet এর ফরাসী বই Functiones Ellipteques থেকে আশুতোষ elliptic function সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন | তিনি ফরাসী, জার্মান ও ল্যাটিন ভাষা ভালো ভাবে শিখেছিলেন | মাত্র ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত আশুতোষ গণিতের গবেষণা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন | বিদেশে না গিয়েও এই গবেষনার মাহাত্ম্যে তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানসমিতি Cambridge Philosophical Society-র Fellow নির্বাচিত হন | গণিতে গবেষণা ও অধ্যাপনা আশুতোষের আকাঙ্ক্ষা ছিল | শিক্ষাবিভাগের অধিকর্তা Alfred Croftতাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার জন্য আহ্বান করলেন | কিন্তু ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান মর্যাদা পাবেননা জেনে তিনি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন |

তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং ১৬ বছর পরে ১৯০৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন | আইনব্যবসা কালে তাঁর আয় মাসে দশ হাজার টাকা ছিল, এখন তাঁর আয় দাঁড়ালো মাসে তিন হাজার | কিন্তু আয় কমলেও অবসর সময়ে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে পারবেন বলে তিনি এই বিচারপতির কাজটিই বেছে নিলেন | তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর | ঊনিশ বছর হাই কোর্টের বিচারপতি ছিলেন এবং ১৯২০ সালে কিছু দিনের জন্য প্রধান বিচারপতি ছিলেন | ১৯০৮ সালে আশুতোষ প্রথমবারের মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন | দু বছর করে আট বছর উপাচার্য ছিলেন | একই সঙ্গে হাই কোর্টের বিচারপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দুটি পদ-ই তিনি অলংকৃত করে ছিলেন -- উপাচার্যের পদটি অবৈতনিক ছিল |

ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পান্ডিত্য ও বহুমুখী গুণবত্তার জন্য `নাইট' উপাধি দিয়েছিলেন | নবদ্বীপের পন্ডিত-সমাজ তাঁকে `সরস্বতী' উপাধি এবং ঢাকার পন্ডিত-সমাজ তাঁকে `শাস্ত্র-বাচস্পতি' উপাধি প্রদান করেন | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষার পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করে পালি ভাষার প্রতি তিনি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন তাঁর জন্য সিংহলের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাঁকে `সম্বুদ্ধাগম চক্রবর্তী' উপাধি দেন | আশুতোষ গণিত-বিষয়ে আলোচনা, গবেষণা ও তার প্রকাশনার জন্য ১৯০৮ সালে Calcutta Mathematical Society প্রতিষ্ঠা করেন | তখন কলকাতা অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল | ব্রিটেনে জাতীয় গণিত-সমিতির নাম London Mathematical Society। উনিও জাতীয় গণিত-সমিতি হিসাবে উপরি-উক্ত নামে এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন | Calcutta Mathematical Society-র সুনাম বিশ্বব্যাপী ছিল ও আছে | প্রফেসর এস. কে. মিত্র. ১৯৯৪ সালে এই সোসাইটির ৮৬-তম বর্ষ-পূর্তি অনুষ্ঠানে Guest of Honour হিসাবে বক্তৃতায় বলেন যে, U.S.A.-তে ত্রিশের দশকে স্থাপিত Institute of Advanced Studies (Princeton)-এ তিনি Bulletin of Calcutta Mathematical Society-র full set দেখেছেন | আবার, Cambridge University-তেও ওই bulletin শুরুর বছর থেকে আছে | এ-দুটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলির অন্যতম |

ছাত্র অবস্থা থেকেই আশুতোষ অনেক বই কিনতেন এবং পড়তেন | প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রাবস্থায় James Clerk Maxwell - এর Electricity and Magnetism Vol. Iও II তে প্রকাশিত Maxwell -এর সদ্য আবিষ্কৃত তত্ত্ব আশুতোষ পড়েছিলেন | কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল | তাঁর শিক্ষক Dr. Bruhe-ও এই বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করতে পারলেন না | পরে ওই তত্ত্ব-সংক্রান্ত Henri Poincare - র বই পড়ে বিষয়টি আত্মস্থ করেন | এত অল্প বয়সে আধুনিকতম তত্ত্ব জানার ও বোঝার আগ্রহ ও ক্ষমতার এই পরিচয়ে বিস্মিত হতে হয় |

আশুতোষের প্রায় পঁচাত্তর হাজার বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন ভাষার মূল্যবান বই ছিল | এগুলি তাঁর উত্তরাধিকারীরা কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে দান করেছেন | আশুতোষ সংগ্রহশালা (Ashutosh Collection ) নামে ওই লাইব্রেরির একটি বিশেষ অংশ জুড়ে আছে এই বইগুলি | পৃথিবী-বিখ্যাত গণিতবিদদের রচিত অনেক বই এর মধ্যে আছে | John Bolyai, Alfred Clebsh, Edward Dickson, O. L. Coolidge, Rene Descartes, Gespard De Monge, George Salmon, David Hilbert, A. M. Legendre, Isaac Barrow, D. E. Smith, K. F. Gauss, D. M. Sommerville, N. I. Lobacheffsky, F. Klein, I. Newton, Leonard Euler প্রমুখ | তাঁর সংগ্রহে ইউক্লিডের ত্রিশটি জ্যামিতি-বিষয়ক বই ছিল, যার মধ্যে ১৫৭০ সালে Billingsley-কৃত ইউক্লিডের বিখ্যাত বই `Elements' - এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদও ছিল |

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা ছিল | অধ্যাপনার ব্যবস্থা শুধু কলেজে ছিল | এম. এ. প্রেসিডেন্সি এবং আর মাত্র দু-একটি কলেজে পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল | আশুতোষ উপলব্ধি করেন, এ-দেশে যথার্থ উচ্চ-শিক্ষা ও গবেষনার ব্যবস্থা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপন্ডিত ও অত্যন্ত মেধাবী দেশী শিক্ষকের সমাবেশ ঘটিয়ে তাঁদের অধ্যাপক নিয়োগ করা প্রয়োজন, এবং তাঁদের পাঠ-দানের উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরী করা প্রয়োজন | এই গুরুদায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে সক্ষম হন | শিক্ষা-বিভাগে ইংরেজ কর্মকর্তাদের প্রচন্ড প্রতিকূলতা-কে তাঁর বাগ্মিতা, দৃঢ় মনোবল ও ওজস্বিতার সাহায্যে প্রতিহত ক'রে, নিজের বহুমুখী পান্ডিত্য ও তীক্ষ্ণ মেধার ঐশ্বর্য্য ব্যবহার করে, এবং দেশের ও জাতির উন্নতির জন্য তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছার জোরে প্রত্যেক বিষয়ে যোগ্যতম শিক্ষক নিয়োগদান করেন | এইভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের মানচিত্রে অনেক সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন | তাঁর উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্য-শিক্ষার ব্যবস্থা হয় | সমস্ত ভারতবাসী, বিশেষ করে বাঙালীর কাছে তাঁর ঋণ তাই অপরিশোধ্য | শিক্ষক-নিয়োগে তাঁর অসাধারণ নির্বাচন-দক্ষতার একটি উদাহরণ দিই | গণিতে সবে এম. এ. পাশ করা সত্যেন বোস ও মেঘনাদ সাহার প্রত্যেককে তিনি এম. এ. ক্লাসে গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন | তাঁরা পুরানো সনাতন বিষয়গুলি পরানো ছাড়াও সদ্য-সৃষ্ট ও নির্মীয়মান যুগান্তকারী Relativity ও Quantum Theory -র তত্ত্বগুলি পড়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর অঙ্গীকার করলেন ও সেইমত পড়ালেন | কয়েক বছরের মধ্যে এইসব বিষয়ে নিজেরাও গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত হয়ে নিজেদের ও আশুতোষের যোগ্যতার প্রমান দিলেন | এইভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাতারে শামিল হলো |

আশুতোষ অত্যন্ত নির্ভীক ও তেজী পুরুষ ছিলেন | এ সম্বন্ধে তিনটি ঘটনার উল্লেখ করে ওঁর প্রসঙ্গ শেষ করছি | প্রথম ঘটনাটি আমার শ্রদ্ধেয় একজনের মুখে শোনা -- এই ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য গণিত-দক্ষতারও দৃষ্টান্ত মেলে |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কাজে শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসাবে আশুতোষ ঢাকায় গিয়েছিলেন | তখন ঢাকা কলেজে একজন ইংরেজ গণিত-অধ্যাপক দেশী ছাত্রদের হেয় ও তাচ্ছিল্য করতেন এবং রূঢ় আচরণ করতেন | ছাত্ররা আশুতোষের কাছে এই বিষয়ে নালিশ করেছিল | উনি তাঁদের বকে দিলেন, শিক্ষকের মর্যাদার রক্ষার কথা মনে করিয়ে দিয়ে | এর পর এক দিন ওই অধ্যাপকের ক্লাস চলার সময় তিনি ও তাঁর অন্যান্য সদস্যরা ওই ক্লাসে উপস্থিত থাকলেন | অধ্যাপক পড়ানোর সময় কোনো একটি অঙ্কের সমস্যা বোর্ডে সমাধান করলেন | আশুতোষ ক্লাসের ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, কত জন বুঝেছে | দেখা গেল, বেশির ভাগ ছাত্রই সমাধানটি বোঝেনি | তখন উনি শিক্ষকটিকে অন্য পদ্ধতিতে অঙ্কটির সমাধান করতে বল্লেন | শিক্ষক আরেকটি সমাধান দিলে, তারপরও দেখা গেল, অনেকেই বোঝেনি | তখন উনি শিক্ষকটিকে আরো অন্য পদ্ধতি চেষ্টা করতে বল্লেন | শিক্ষকটি না পেরে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন | তখন আশুতোষ নিজে বোর্ডে গিয়ে একের পর এক মোট দশ রকম পদ্ধতিতে অঙ্কটি সমাধান করলেন, এবং শেষকালে দেখা গেল, প্রত্যেক ছাত্রই তা বুঝেছে | শিক্ষকটির অবস্থা তখন কাহিল !

একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে আশুতোষ আলীগড় গিয়েছিলেন | ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় কলকাতায় ফিরছেন | ওই কামরায় এক ইংরেজ মিলিটারী অফিসার ছিলেন | এক সময় আশুতোষের তন্দ্রা এসে যায় | জেগে দেখেন, তাঁর চটি-জোড়া নেই | অর্থাত্, সাহেব ফেলে দিয়েছেন | পরে সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে তিনি সাহেবের খুলে-রাখা কোট বাইরে ফেলে দিলেন | সাহেব জেগে উঠে কোট খুঁজছেন | আশুতোষকে জিজ্ঞাসা করলে উনি বললেন, `তোমার কোট আমার জুতো আনতে গেছে' |

১৯২৩ সালে সরকারের বশংবদ হয়ে থাকার শর্ত মেনে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার প্রস্তাব করা হয় | উনি শুধু ঘৃনাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানই করলেননা, খবরের কাগজে সব কিছু প্রকাশ করে জন-সমক্ষে বিষয়টি তুলে ধরলেন |

তাঁর এই অসামান্য তেজের জন্য তাঁকে `বাংলার বাঘ' বলা হয় |

১৮৬৬ সালে চট্টগ্রামে এক গণিত-প্রতিভার জন্ম হয় | তাঁর নাম অপূর্ব চন্দ্র দত্ত | কারো কারো লেখায় তাঁকে Wrangler বলে উল্লেখ করা হয়েছে | কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ডিগ্রীতে লেখা আছে `Senior Optime' | এর অর্থ, সামান্য কিছু নম্বরের জন্য তিনি Wrangler হতে পারেননি | তাঁকে তাই `প্রায়-Wrangler ' বলা যায় | তাঁর বিষয়ে এরকম আরেকটি জনশ্রুতি পরে ভ্রান্ত প্রমানিত হয়েছে | সাধারণ ভাবে জানা যায় যে তিনি Royal Astronomical Society-র Fellow ছিলেন, আবার Royal Meteorological Society-রও Fellow ছিলেন | কিন্তু তাঁর Royal Meteorological Society-র Fellowship অভ্রান্ত হলেও Royal Meteorological Society-র তিনি Fellow ছিলেননা | Astronomy -তে তাঁর অবশ্য গভীর পান্ডিত্য ছিল, এবং `জ্যোতিষ-দর্পণ' নামে তিনি একটি বই রচনা করেন | Meteorology বিষয়ে তাঁর অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় | গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে তাঁর গভীর উত্সাহ ও প্রগাঢ় পান্ডিত্য ছিল | ইংরেজি, ফরাসী ও ল্যাটিন ভাষায় বিশ্ব-বিখ্যাত মনীষীদের লেখা অনেক বই তাঁর সংগ্রহে ছিল | তাঁর উত্তরাধিকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর অনেক মূল্যবান বই উপহার দিয়েছেন | এর মধ্যে Kepler -এর Astronomia Nova (১৬০৯), Tycho Brahe-র প্রস্তুতকৃত গ্রহ-তারা সম্পর্কিত table থেকে Kepler -এর রচিত Tabulae Rudolphinae , গ্রেগরি-র The Elements of Physical and Geometrical Astronomy (যার সঙ্গে Halley-র ১৭২৬ সালে দুই খন্ডে প্রকাশিত Synopsis of Astronomy of Comets-ও সংযুক্ত ছিল), U-J.Le Verriere -এর Developments sur plusieurs points dela Theorie des Planets (১৮৪২), Researches sur les movement de les Planet Hershel (১৮৪৬) ও Bessel -এর Tabulea Regtomontanae (১৮৩০) রয়েছে |

অপূর্ব চন্দ্র দত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা ও প্রশাসনে নিযুক্ত ছিলেন | সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজে তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন |
এবার একজনের কথা লিখব, তিনি Senior Wrangler হয়ে ছিলেন | এ. সি. ব্যানার্জি. ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করেন | এর পর কেমব্রিজে Clare College- এ ১৯১৫-১৯১৯ সময়কালে Senior Wrangler হন এবং দুর্লভ Owst Prize অর্জন করেন| তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী Eddington, Chapman, Larmor ও C. T. R. Wilson-এর কাছে Cavendish Laboratory- তে গবেষণা করেন | তাঁর প্রথম গবেষণা-কর্মটির নাম `The Instability of Radial Oscillations of a Variable Star and Origin of Solar System' | এটি সৌরজগতের সৃষ্টি সম্পর্কিত একটি তত্ত্ব | Sir James Jeans-এর এই বিষয়ক তত্ত্বের সঙ্গে এটির মিল এবং অমিল দুই-ই আছে | এ. সি. ব্যানার্জির তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক-মহলে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল | প্রফেসর ব্যানার্জি পরে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে এলাহাবাদে অনেক যৌথ গবেষণা করেন | এছাড়া Astrophysics -এ নিজামুদ্দীন ও ভাটনগরের সঙ্গে তাঁর ভালো ভালো গবেষণা-প্রবন্ধ আছে | এ. সি. ব্যানার্জির বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-এর সমসাময়িক এবং কলেজের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন |

এবার তিন অসাধারণ প্রতিভার সম্বন্ধে সংক্ষেপে এক সঙ্গে আলোচনা করব | এঁরা প্রায়-সমসাময়িক এবং পরস্পর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন | এক সঙ্গে কাজ-ও করেছেন | তিনজনেই F. R. S. হয়েছিলেন এবং তিনজনই বিশ্ববিখ্যাত | এঁরা মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬), প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২) এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) | এর মধ্যে প্রথম দুজনের বাড়ি তত্কালীন ঢাকা জেলায় এবং শেষজনের বাড়ি কলকাতায় | সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা সহপাঠী এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন | ১৯১৩ সালে গণিতে অনার্স, এবং ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে এম. এ. | এ দুটি পরীক্ষাতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম এবং মেঘনাদ দ্বিতীয় হন | ওঁদের এম. এ. পরীক্ষার কিছু আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশী প্রফেসর নিয়োগের কর্মসূচীর আওতায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গনেশপ্রসাদ নামে একজন মহাপন্ডিত জ্ঞান-তাপসকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের দায়িত্ব দেন | তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম গণিতজ্ঞদের অন্যতম জার্মান গণিতজ্ঞ Felix Klein -এর কাছে গবেষণা করেছিলেন | তাঁর প্রশ্নপত্র অত্যন্ত কঠিন এবং অনেক নতুন গাণিতিক শব্দ ও বিষয় সমন্বিত থাকায়, এই পরীক্ষায় অনেক ভালো ছাত্রেরও বেশ অসুবিধা হয়েছিল | তবে সত্যেন্দ্রনাথকে, এবং সম্ভবত মেঘনাদকেও, এই প্রশ্ন অসুবিধায় ফেলতে পারেনি | কারণ, এ-সত্ত্বেও, সত্যেন্দ্রনাথ মিশ্র গণিতে এম. এ. পরীক্ষায় শতকরা ৯২ নম্বর পেয়ে প্রথম হন | এইটি এখনো পর্যন্ত রেকর্ড নম্বর | প্রশান্তচন্দ্র কলকাতা থেকে অনার্স পাশ করে কেমব্রিজে পড়তে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হন | এঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ পদার্থবিদ হিসাবে এবং প্রশান্তচন্দ্র পরিসংখ্যানবিদ হিসাবে বিশ্ববিখ্যাত হন | তবে, গণিত এঁদের প্রায় সব গবেষণা-কাজে মূল শক্তি ছিল |

মেঘনাদ সাহা এম. এ. পাশ করার পরপরই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ পরীক্ষা পাশ করেন এবং ভালো গবেষণা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেন | সেই সময় নির্মীয়মান কোয়ান্টাম তত্ত্ব, বিশেষ করে Max Planck ও Niels Bohr -এর গবেষণা-লব্ধ ফল ব্যবহার করে তারার ঔজ্জ্বল্য ও তাপমাত্রা সম্পর্কিত তাঁর গবেষণা তাঁকে বিশ্বখ্যাতি দান করে এবং তিনি খুব অল্প বয়সে F. R. S. হন | পরে তিনি দেশে-বিদেশে এই বিষয়ে এবং তাত্ত্বিক পদার্থ-বিদ্যার অন্যান্য বিষয়ে অনেক উচ্চমানের গবেষণা করেন | Astrophysics-এ মেঘনাদ সাহার তত্ত্ব ওই বিষয়ে প্রথমদিককার মৌলিক গুরুত্ত্বপূর্ণ তত্ত্বের অন্যতম | গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আর্থিক অসচ্ছলতা ও তত্কালীন সামাজিক প্রতিকুলতা সত্ত্বেও তিনি তীক্ষ্ণ মেধা ও কঠোর সাধনার জোরে বিশ্ব-বরেণ্য হয়ে শুধু নিজের নয়, বাংলা, তথা সমগ্র উপমহাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন | তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত Saha Institute ভারতের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান |

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কেমব্রিজে J. J. Thompson বা ওই মাপের বড় পদার্থবিদের সঙ্গে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য গবেষণা করার কথা স্থির হয়েছিল | কিন্তু অনার্স পাশ করে দেশে বেড়াতে এসে প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে তখন তাঁর বিলাতে ফেরা হলো না | তাই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যপনা শুরু করেন | ওই অবস্থায় কলকাতার ওই কলেজেই তাঁর পরিসংখ্যান বিষয়ে গবেষণা শুরু হয় | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফলাফল, ভারতীয় Geological Survey -র তথ্যাদি ইত্যাদি নিয়ে তাঁর গবেষণার সূত্রপাত | যেকজন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির গবেষণা মূল পরিসংখ্যান বিষয়ের ভিত্তি, প্রশান্তচন্দ্রর গবেষণা তার অন্যতম | নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি -- এসব বিষয়েও তাঁর গভীর দখল ছিল এবং এইসব নিয়ে তাঁর ভালো গবেষণা-কাজ আছে | তিনি ১৯৪৫ সালে F. R. S. হন | প্রশান্তচন্দ্রর একটি বিশাল কীর্তি Indian Statistical Institute প্রতিষ্ঠা করা | প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগে কর্মরত অবস্থায় তাঁর প্রভূত গবেষণার মাধ্যমে সেখানেই এই Institute - এর গড়া-পত্তন হলেও প্রশান্তচন্দ্র কলকাতার বরানগরে নিজের সম্পত্তির একটি বিরাট ভূখন্ডে এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন -- এরই চত্তরের মাঝখানে প্রশান্তচন্দ্রের নিজের বাড়ি (রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত নাম, `আম্রপালী') | এইটি এখন তাঁর স্মৃতিবাহী সৌধ (museum) | ভারতের আরো কয়েকটি শহরে এই Institute - এর শাখা আছে | পরিসংখ্যানকে কেন্দ্র করে এই Institute - এ অনেক বিষয়ে খুব উচ্চ-মানের পঠন-পাঠন ও গবেষণা হয় | এটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিসংখ্যান শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র | এখানকার প্রাক্তন শিক্ষক, গবেষক, গবেষণা-পরিচালক এবং Institute -এর প্রাক্তন পরিচালক Professor C. R. Rao একজন F. R. S. এবং বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পরিসংখ্যানবিদদের অন্যতম | কলকাতার এই Institute -এ Prof. Rao -এর তত্ত্বাবধানে Ph. D-করা Professor Vardhan U.S.A-র বিখ্যাত Courant Institute -এর পরিচালক, যিনি গণিতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার (Abel পুরস্কার) অর্জন করেছেন |

সত্যেন্দ্রনাথ এম. এ. পাশ করার পর প্রথমদিকে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে কিছু ভালো গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশ করেন | Einstein-এর General Relativity তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পরে ১৯১৯ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে এই তত্ত্বের সত্যতা নির্ধারিত হয় | এর ফলে, নিউটনীয় মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বের তুলনায় এই তত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব সুস্পষ্ট ভাবে প্রমান হয় এবং বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয় | তখন মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞানী এ তত্ত্ব বুঝতেন | এসময় ১৯২০ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ Special ও General Relativity তত্ত্বের মূল তিনটি জার্মান গবেষণা-প্রবন্ধ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, এবং প্রশান্তচন্দ্রের অত্যন্ত সুলিখিত একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা সহ এগুলি একটি বই আকারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় | Einstein ও Minkowski -র ওই গবেষণা প্রবন্ধ গুলি এই প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হলো | সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ ১৯১৬ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যপনা শুরু করেন -- পদার্থবিদ্যা বিভাগেরও এই সূচনা | এঁরা দুজনে নবীন হলেও পুরানো বিষয়গুলির সঙ্গেসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর পদার্থ-বিজ্ঞানের দুটি স্তম্ভ Relativity ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিতে এঁরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, নিজেরাও এই সব বিষয়ে গবেষণায় সচেষ্ট ছিলেন | তাঁরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতেরও শিক্ষক ছিলেন | ১৯২১ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং মেঘনাদ কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন | ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সত্যেন্দ্রনাথের একটি গবেষণা-প্রবন্ধ Einstein-এর উদ্যোগে জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয় | এর বিষয়বস্তু Bose-Einstein Statistics বা Bose-Statistics নামে খ্যাত | এই প্রবন্ধ তাঁর বিশ্বখ্যাতির উত্স | ইলেকট্রন, প্রোটন ইত্যাদি যথা মৌলিক কনিকা বিশ্বব্রহ্মান্ডে বিরাজমান, তাদের দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ; boson (সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে) এবং fermion (ইতালীয় বৈজ্ঞানিক Enrico ফের্মি -র নামে) | এই দুই রকম ছাড়া অন্য কোনো ধরনের মৌলিক কণিকার অস্তিত্ব নেই | এ থেকে সত্যেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি | ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে সত্যেন্দ্রনাথ আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন | ঢাকা এবং কলকাতায় উনি পদার্থবিদ্যায় একইসঙ্গে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষাগার ভিত্তিক কয়েকটি বিষয়ে গবেষণা করেন | ১৯২৪-২৫ সময়কালে উনি আর্থিক আনুকুল্য সহ ইউরোপে শিক্ষা-সফরের সুযোগ পান | তখন তিনি Einstein , মাদাম ক্যুরি, Louis de Broglie প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে মিলিত হন, এবং এঁদের অনেকের পরীক্ষাগার এবং পরীক্ষা-পদ্ধতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জেনে দেশে কিছু কিছু নতুন প্রয়োজনীয় যন্ত্র নিজে উদ্ভাবন করে ও প্রস্তুত করিয়ে পরীক্ষাগারে স্থাপন করেন | তাঁর ছাত্রেরা ওই যন্ত্রের সাহায্যে গবেষণা করেছেন | রসায়ন-শাস্ত্র সম্বদ্ধে তাঁর জ্ঞান গভীর ছিল এবং এই বিষয়েও তিনি গবেষণা পরিচালনা করতেন | ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণের অব্যবহিত আগে Einstein-এর Unified Field Theory বিষয়ে তাঁর চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-প্রবন্ধ U.S.A. ও ফ্রান্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় | ১৯৫৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ F. R. S. হন | ত্রিশ-চল্লিশের দশকে প্রশান্তচন্দ্রের পরিসংখ্যান বিষয়ক তত্ত্বের সম্পৃক্ত কয়েকটি বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন | তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় ও পরিসংখ্যানের সত্যেন্দ্রনাথের কাজ তাঁর গভীর গণিত-জ্ঞান ও গণিত-ব্যবহারের অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচায়ক | শেষ বয়েসে তিনি প্রথমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন | পরে তাঁকে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয় | সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ভারত সরকার কলকাতায় তাঁর নামে একটি উচ্চমানের Research Institute প্রতিষ্ঠা করেছেন |

মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু, তিন জনই ভালো বাংলা লিখতে পারতেন এবং বাংলায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞানের অনেক বিষয় খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন | তাঁদের রচিত বাংলা বইও আছে |

গণিতে অসাধারণ ব্যুত্পত্তি ও দক্ষতার অধিকারী এই তিন মনীষীর ত্রিবেণী-সঙ্গম গণিত-ভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলাকে বিশ্বসভায় সম্মানের আসনে বসিয়েছে | এঁদের সহগামী ও অনুগামী আরো গণিত-প্রতিভা আছেন | তাঁদের কথা আমরা বিস্মৃত হইনি, তবে এখানে তাঁদের সম্বন্ধে আলোচনা করছি না |

তথ্য-সূত্র

১. স্বপন ধর, `উপমহাদেশের প্রথম রাংলার ময়মনসিংহের আনন্দমোহন বসু, ব্রহ্মশৈলীর গবেষণা-পত্র চিরকুট (আনন্দমোহন কলেজ সংখ্যা), ৩০ জানুয়ারী ২০১০, পৃঃ ৪৯ |
২. আশরাফুল ইসলাম, রাংলার আনন্দমোহন বসু : স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ', প্রাগুক্ত, পৃঃ |
৩. রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী, আশুতোষ, প্যাপিরাস, আগস্ট ২০০২ |
৪. Sailesh Dasgupta, `The mathematical contributions of Sir Ashutosh Mukhopadhyay', News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 13, No. 1, Jan. 1990.
৫. S. K. Mitra, Speech of the Guest of Honour on the 86th foundation day anniversary of the Calcutta Mathematical Society, News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 17, No. 10, Oct. 1994.
৬. K. Venkatachaliengar, `On a paper of Ashutosh Mukhopadhyaya', News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 13, No. 6, June 1990.
৭. Manibur Rahman Chowdhury, `Apurba Chandra Dutta and ``Jyotish Darpan''',J. Asiatic Soc. (Kolkata), Vol. 47, No. 1, 2005, pp. 87-92.
৮. H. C. Khare, `Scientific Contributions of Professor A. C. Banerjee (1891-1968)', News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 13, No. 12, Dec. 1990, pp. 1-5.
৯. জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি (জে. বি. এস. হলডেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ), কলকাতা পুরসভা, ১৯৯৪ |


(This article was published in `Banga, Bangla, Bangladesh' - a collection of articles, Bangladesh, 2010.)

Thursday, August 5, 2010

আমার শিক্ষক শহীদ অধ্যাপক হবিবুর রহমান

-সুব্রত মজুমদার

১৯৬০ থেকে ১৯৬২, এই দুই বছর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে M.Sc ক্লাসে ছাত্র থাকার সময় হবিবুর রহমান সাহেব আমার শিক্ষক ছিলেন| ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তাঁকে আমি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি | এই সময় তাঁকে কাছ থেকে দেখতে পারার এবং গণিত বিষয়ে শিক্ষকতা, অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁর নিরলস আত্মনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার প্রয়াসের অঙ্গ হিসেবে, এক দিকে ক্রীড়া-সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে বিচরণ, অন্য দিকে সামাজিক দায়িত্ব-পালনে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে চিত্তের প্রসার ও মহত্ত্ব-অর্জনের প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে | আমি যদি সামান্য কিছু গণিত শিখতে পেরে থাকি, গণিত যদি আমার হৃদয়ের ধন হয়ে থাকে, এবং যদি আমি মনুষ্যত্ব-লাভের সামান্য পাঠ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে থাকি, তাহলে তার অন্যতম কারণ, এই মহান ব্যক্তিত্বের সস্নেহ সান্নিধ্য-লাভ |

সংক্ষেপে তাঁর বিষয়ে কিছু লিখব |

হবিবুর রহমান সাহেবের স্কুল ও জীবনের পরীক্ষাগুলি অত্যুজ্জ্বল কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে | ব্রিটিশ আমলের প্রায় শেষ প্রান্তে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে M.Sc পাশ করেন | আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের একটি অনন্য-উজ্জ্বল দিক আছে | যদিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র-গবেষক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা বিশ্ববিখ্যাত, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রামানুজনের মত বিশ্বের সর্বকালীন বিস্ময়কর গণিত-প্রতিভা গবেষণা করেছেন, লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক আব্দুস সালাম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তবু আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শুরুর দিকে বিশ্বের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের একজন বিভাগের প্রধান হিসেবে, কর্ণধার হিসেবে ছিলেন বলে এই বিভাগ প্রথম থেকেই বিশ্বমানের আস্বাদন পেয়েছিল, যা সম্ভবত অন্যত্র ঘটেনি | এই গণিতবিদ আঁদ্রে ওয়াইল (Andre Weil) | গত শতাব্দীর শেষ দিকে তাঁর মৃত্যু হয় | প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Ph. D. করে এই উপমহাদেশে এসে অত্যন্ত অল্প বয়সেই মহা পন্ডিত এই ফরাসী নবীন যুবা কঠোর হাতে প্রকৃত জ্ঞানী ও মেধাবীদের সমাবেশ ঘটিয়ে গণিত বিভাগ গড়ে তোলেন |

আঁদ্রে ওয়াইল-এর অসাধারনত্ব নিয়ে দু-একটি কথা বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবেনা | খুব অল্প বয়েসে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়তে ঢুকে, উনি প্রথম বছরেই অনার্সের সম্পূর্ণ পাঠ্য-সূচী নিজে পড়ে ফেলেন | এছাড়া, উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান গণিতবিদ রীমান (Reimann) - এর সবকটি গবেষণা-পত্রও ওই বছর নিজে পড়ে ফেলেন | অনার্স পাশ করার পর বয়স কম থাকে ওঁকে Ph. D.-র কাজ শুরু করতে দেয়া হয়নি | এক বছর ইতালিতে ও জার্মানির Gottingen-এ পন্ডিতদের সাহচর্যে থেকে তারপর প্যারিসে এসে Ph. D. থিসিস রচনা করেন | তাঁর Ph. D. থিসিসের পরীক্ষক নির্ধারণ করার দায়িত্ব প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকেই দেন!

ইস্কুলে ঢোকার আগে দু-এক মাস সময় হাতে পাওয়ায় আঁদ্রে ওয়াইল সংস্কৃত শিখে ফেলেন | এত অল্প সময়ে কিন্তু তিনি শুধু ভাষা নয়, সাহিত্য-ও পড়ে ফেলেন | কালিদাসের কাব্যের কিছু কিছু অংশ অনেক কাল পরেও তাঁর মুখস্থ ছিল | সম্ভবত এই পটভূমির কারণে বিখ্যাত ফরাসী ভারত-তত্ত্ববিদ (Indologist) Sylvan Levi তাঁকে ভারতে অধ্যাপনা করতে যেতে বলেন | তাঁর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার এই পটভূমি |

রহমান সাহেবের গণিত-স্পৃহা ও গণিত-অনুসন্ধিত্সার সুচনা সম্ভবত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়েই রচিত হয় | এছাড়া, চাকরি জীবনের প্রথমেই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা এই সূচনাকে দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব দিয়েছে | কারণ, এই কলেজেই অখন্ড ভারতের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অধিকাংশ শিক্ষা-লাভ করেছিলেন | এখানে আরো অন্যদের মধ্যে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেছেন জগদীশ চন্দ্র বোস, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ প্রমুখ, বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকরা |

পরবর্তীকালে, যখন রহমান সাহেব কেমব্রিজে অধ্যয়ন করেন, তখন সেখানে বিশ্বের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা-গবেষণা-কেন্দ্রের পরিবেশ, অসংখ্য গুনী ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ও তাঁদের কারুর কারুর বক্তৃতা শোনা – এই সবই তাঁর বুদ্ধি ও জ্ঞানের দিগন্তকে অনেক বিস্তৃততর করে তোলে | বিশুদ্ধ গণিত, ফলিত গণিত এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় তাঁর জ্ঞান-লাভের ও গবেষণার স্পৃহা এখানে সৃষ্টি হয়, যা সারা জীবন জাগরুক ছিল | তাঁর পছন্দের সব চেয়ে মেধাবী পন্ডিত যাঁরা, সব চেয়ে বড় প্রতিভার অধিকারী যাঁরা, তাঁদের প্রয়াস সম্বন্ধে অবহিত থাকার চেষ্টা তিনি করতেন এবং অনুরূপ প্রয়াসে অংশ নিতে চাইতেন | ওই সব বিষয় যাঁরা জানতেন, এবং ওই সব প্রয়াসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল, শুধু তাঁরা জানেন বা বুঝতে পেরেছেন রহমান সাবের মূল্য -- গণিতবিদ হিসেবে, গবেষক হিসেবে |

দু-একটা সাধারণ সমস্যার সমাধান করে গবেষণাপত্র রচনা করা ও তা প্রকাশনার মাধ্যমে চাকরি ও সামাজিক জীবনে আরো উঁচু প্রতিষ্ঠা লাভ করার বাসনা তাঁর ছিলনা | সব চেয়ে বড় গণিতবিদদের যে সব সমস্যা পরাস্ত করত, তার কয়েকটি সমাধানের জন্য তিনি অহর্নিশ চেষ্টা করতেন | Theory of Numbers-এর Fermat's Last Theorem নামে পরিচিত সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো একটি সমস্যা তাঁর প্রিয় ছিল | এর দুটি স্বতন্ত্র সমাধান তিনি দিয়েছিলেন, যদিও সফল হননি | এত বছর ধরে পৃথিবীর প্রায় সব বড় গনিতবিদেরাও এই সমস্যার কাছে পরাস্ত হয়ে ছিলেন -- শেষ পর্যন্ত কেমব্রিজের ছাত্র-গবেষক এবং প্রিন্সটনের শিক্ষক-গবেষক গণিতবিদ Andrew Wiles এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান দেন | ওঁর প্রমাণে একটি ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ ছিদ্র ছিল, সেটি দূর করার ব্যবস্থা করেন কেমব্রিজে ওঁর গবেষক-ছাত্র Taylor |

Goldbach's Conjecture নামে ওই রকম একটি Number Theory - র পুরনো একটি সমস্যার আজ কেউ সমাধান করতে পারেনি | রহমান সাহেব এই সমস্যা-সমাধানের জন্য অনেক সময় ও শক্তি ব্যয় করেছেন | USA -র Clay Mathematics Institute ওই সমস্যার সমাধানের পুরস্কার হিসেবে এক মিলিয়ন ডলার দেবার অঙ্গীকার করেছে |


রহমান সাহেব Theoretical Physics - এর Quantum Field Theory বিষয়ে পড়াশোনা করে Particle Physics এ গবেষণা করছিলেন | USA র Maryland Universityতে প্রায় একবছর ছিলেন | কোনো তত্ত্বের বিষয়ে ভাসা-ভাসা জেনে কাজ করার পক্ষপাতী তিনি ছিলেননা, গভীরে গিয়ে সব বুঝে, মৌলিক কিছু করার প্রয়াসী ছিলেন | এর ফলে, ভালো ফল পাবার জন্য তাঁকে কঠোর অধ্যাবসায় এবং প্রচুর সময় ও শ্রম দিতে হচ্ছিল | মুক্তিযুদ্ধে তাঁর আকস্মিক হত্যার ফলে এ বিষয়ে তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনা অন্তর্হিত হলো |


শিক্ষক হিসেবে হবিবুর রহমান কেমন ছিলেন প্রশ্ন করলে, সবার কাছ থেকে হয়ত একরকম উত্তর পাওয়া যাবেনা | আমরা যখন পড়তাম,সব চেয়ে উঁচু ক্লাসগুলোয় পড়লেও (তখন অনার্স দু বছরের এবং দু-একটি কলেজে পড়ার ব্যবস্থা ছিল ও M.Sc দু বছরের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যবস্থা ছিল) রহমান সাহেব ক্লাসে পড়া না বলতে পারলে ইস্কুলের মত ছাত্রদের দাঁড় করিয়ে দিতেন! কেউ যদি বলত, পারব না, উনি বলতেন, পারতেই হবে! এসব শুনে আশ্চর্য লাগতে পারে, ওঁকে খুব ভালো নাও মনে হতে পারে | কিন্তু তাঁর এই কঠোর ভাব একান্ত বাহ্যিক -- ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণের জন্য, তারা যাতে পড়াশোনায় ও নতুন বিষয়ে শেখায় বেশি মনোযোগী হয়, এবং নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করতে শেখে, এই ছিল তার ঐকান্তিক বাসনা | ক্লাসের বাইরে বা তাঁর বাসায় গেলে তিনি খুব মিষ্ট ব্যবহার করতেন | হাসি মুখে নানান খাবার দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করতেন | তবে অঙ্কের ব্যপারে তাঁর কোনো compromise ছিলনা| অঙ্ক আয়ত্ত করার যে কোনো আরামের পথ নেই, সেটা মনে করিয়ে দিতেন | সহজ জনপ্রিয়তার পথে তিনি চলতেন না | ক্লাস-নোট যা দিতেন, তার মান উঁচু ছিল -- বুঝিয়ে দিতেননা, বলতেন, বুঝে নাও নিজে, বলতেন, মাথা খাটাও | নিজে কষ্ট করে, পরিশ্রম করে নোট গুলি তৈরী করতেন -- নতুন বিষয় হলে, একটু সময় নিয়ে নোট তৈরী করতেন | ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্লাসে তাঁর কাছে পাঁচটি বিষয় পড়েছিলাম -- তার দুটি বিশুদ্ধ গণিতের, এবং তিনটি ফলিত গণিতের | সেই জন্য তাঁর শিক্ষকতার বিষয়ে বিশদ জানি |

ক্লাসে পড়ানোর সময় রহমান সাহেব অনেক বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদদের জীবনের কিছু কিছু ঘটনা সম্বন্ধে মাঝে মাঝে সংক্ষেপে বলতেন -- আমাদের অনুপ্রাণিত করতে | উনি অনেক বড় প্রতিভার সান্নিধ্যে এসেছেন, বিশেষ করে কেমব্রিজে | ওখানকার গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন সর্বকালীন সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম প্রফেসর পি. এ. এম. ডিরাক | ইনি বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদ্যার দুই স্তম্ভের অন্যতম Quantum Mechanics বিষয়টির অন্যতম স্রষ্টা, anti-particle তত্ত্বের জনক | এঁর গাণিতিক পান্ডিত্য ও গভীরতা এবং মেধার প্রাখর্যের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিদরাও তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা-সমীহ করে চলতেন | রহমান সাহেব এঁর সম্বন্ধে আমাদের বলতেন এবং ওঁর লেখা বই বেশী অনুসরণ করতেন | এসব অসাধারণ গুনী ব্যক্তিদের বিষয়ে জেনে আমরা আলোকিত বোধ করতাম, জ্ঞানের জগতে কূপমন্ডুক না থাকার তাগিদ বোধ করতাম | এঁদের অনুপ্রেরনায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বড় কেউ হতে পারিনি ঠিকই, তবে নিজে কত নগন্য, অন্তত সেটা বোধ করতে শিখেছি |


হবিবুর রহমান সাহেবের জ্ঞান-পিপাসা ও তা চরিতার্থ করার অক্লান্ত প্রয়াস জীবনব্যাপী ছিল | যদিও তিনি অত্যন্ত সামাজিক ছিলেন এবং নিয়মিত সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যেতেন, রাত্রে খাবার পর অনেকক্ষণ তাঁর নিজস্ব পড়াশুনো চলত | তাঁর বাড়িতে অনেক বিশ্ববিখ্যাত লোকের লেখা বিখ্যাত বই ছিল | এর কয়েকটি ভাবী (মিসেস হবিবুর রহমান) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগকে উপহার দিয়েছিলেন (একটি আলমারি সহ) | দুঃখজনক এই যে গণিত বিভাগের প্রায় কেউ সেসব বই পড়ার চেষ্টা করেননা |

গণিতবিদ, গণিত-শিক্ষক হবিবুর রহমান আবার অসাধারণ সুন্দর সব মানবিক গুনাবলীর আধার ছিলেন | অসাম্প্রদায়িকতা, মানব-হিতৈষণা তাঁর উদার হৃদয়ের ভিন্ন ভিন্ন দিক | তিনি মানবতাবাদী মনীষী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন | এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন | ১৯৬২ সালে রাজশাহীতে ওই ধরণের অবস্থা সৃষ্টির সম্ভাবনা হওয়ায় তাঁর অনুরূপ উদ্যমের প্রস্তুতি ছিল |

১৯৬৯ সালে ডক্টর শামসুজ্জোহা মিলিটারির গুলিতে ও বেয়নেটের আঘাতে নিহত হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে যে সভা আহ্বান করা হয়, সেখানে তত্কালীন সরকারপন্থী একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সরকারী কর্মকর্তা সদস্য হিসেবে ওই সভায় যোগ দিতে আসেন| জোহা সাহেবের হত্যায় ক্ষুব্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মচারী তাঁকে অপমান করার জন্য ঘিরে ফেলে | তখন হবিবুর রহমান সাহেব তাঁকে মুক্ত করে সভায় তাঁর যাবার ব্যবস্থা করেন | অথচ ওই সরকারপন্থী ভদ্রলোক তারই কিছু দিন আগে রহমান সাহেবের নামে আদালতে অত্যন্ত অপমানজনক অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন | উপরি-উক্ত ঘটনা ওই মামলা চলাকালীন সময়ে ঘটে |

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর হওয়ার মাত্র কয়দিন পরে, ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে, রাজশাহী শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কিছু দিনের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল | যদিও হবিবুর রহমান সাহেব সক্রিয় ও অকুন্ঠ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন ও সহায়তা করেছেন, তবু তিনি কোয়ার্টার ছেড়ে যাননি এবং এসময়ে তাঁর কোনো সহকর্মী পাকিস্তানী সেনাদের সহযোগিতা করা সত্ত্বেও সেই ব্যক্তিকে তাঁর বাসায় আশ্রয় দিয়ে তত্কালীন মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে রক্ষা করেন | উনি ভেবেছিলেন খুব শীঘ্রই আইনের পথে ব্যক্তিটির সঠিক বিচার হবে, এবং সেইটি-ই ন্যায্য | কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এর কয়দিন পরেই ঢাকা থেকে অনেক পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এসে পড়ায় রাজশাহী তাদের দখলে চলে যায়, মুক্তিযোদ্ধারা সেই সময় সাময়িকভাবে পরাস্ত হয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হন | এই সময়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা রহমান সাহেবকে তার কোয়ার্টার থেকে ধরে নিয়ে যায়, এবং এর পর তাঁর কোনো হদিস আর পাওয়া যায়নি | সবচেয়ে দুঃখজনক এই যে উপরি-উক্ত সহকর্মী বা তাঁর কোনো বন্ধুবান্ধব রহমান সাহেবকে মুক্ত করার বা তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যকে সাহায্য করার চেষ্টা করেননি | রহমান সাহেবের সহমর্মী মন সহকর্মী বন্ধুদের বিপদকে নিজের বিপদ বলেই মনে করেছেন | সবাই তো এত উদার নয়!

হবিবুর রহমান সাহেবের উদার, নির্মল, কোমল মনের সুন্দর ছবি এই সব ঘটনায় ফুটে ওঠে | আবার তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সত্সাহসের পরিচয় পেয়ে আমরা শ্রদ্ধায় বিনত হই |