কয়েকটি অসামান্য বাঙালী গণিত-প্রতিভা
-সুব্রত মজুমদার
`What Bengal thinks today will India think tomorrow' -- শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ও বাঙালীর অগ্রবর্তিতা সম্পর্কে মহামতি গোখলের এই উক্তি সে-যুগে ভারতের গণিতচর্চার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য | পাশ্চাত্য শিক্ষা সূচনার পর ভারতবর্ষে প্রথম গণিত-শিক্ষায় বিশ্বমানের সাফল্য, এবং বিশ্ব-মানের গণিত গবেষনার কৃতিত্ব বাঙালীর | এই পথিকৃত্-দের প্রায় অব্যবহিত পরেই অন্তত তিনজন বাঙালী গণিত ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন|
প্রাচীন কালে যে সব দেশ গণিত-চর্চায় অনেক উন্নতি করেছিল, তার মধ্যে অবিভক্ত ভারতবর্ষ অন্যতম | মধ্যযুগেও, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য প্রমুখ, এই উপমহাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন | এ-যুগের `শুন্য'-র আবিষ্কার ও ব্যবহার বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবীয় বৈজ্ঞানিকরা অবগত হন | এবং পরে তাঁদের মাধ্যমে ইউরোপে এই ধারণার প্রসার ঘটে -- গণিত ও বিজ্ঞানের জগতে এর ফলে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে | এসব সময় অবশ্য কোনো বাঙালীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়না | তাই গণিতে বাঙালীর প্রথম শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব-অর্জনের কৃতিত্ব উল্লিখিত ঊনবিংশ শতাব্দীর ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদের কয়েকজন মনীষীর | এঁদের কয়েকজন সম্পর্কে এখানে কিছু লিখব |
ভারতবর্ষ এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত থাকায়ব্রিটিশ আমলেই এখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটে, ফলে বৃটেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডে পড়াশুনো করে পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করা এবং ইংল্যান্ডের Royal Society-র Fellow (F.R.S) হওয়া শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন বলে আমরা স্বীকার করি | আন্তর্জাতিক ভাবে সমস্ত পৃথিবীতেই এই সবের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত | যে-গণিতবিদদের সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করব, তাঁদের বেলায়ও এই সব মাপকাঠি আমরা ব্যবহার করব |
বিলাতের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পরীক্ষায় (Mathematical Tripos প্রথম দুই Part) First Class পেলে পরীক্ষার্থীকে Wrangler বলা হয় | বিশেষ কৃতিত্ব হিসেবে সর্বত্র এর স্বীকৃতি রয়েছে | এই উপমহাদেশের প্রথম Wrangler বাঙালী আনন্দমোহন বসু | এঁর জন্ম ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মৃত্যু ১৯০৬ সালের ২০ অগাস্ট | জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার) জয়সিদ্ধি গ্রামে | অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী আনন্দমোহন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৬২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় নবম হন | এর পরে এফ. এ. , বি. এ., ও গণিতে এম. এ. পরীক্ষার প্রত্যেকটিতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন | এর পর তিনি প্রেম চাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি অর্জন করেন এবং বিলাতে যাবার জন্য দশ হাজার টাকা বৃত্তিলাভ করে কেমব্রিজে ক্রাইস্ট-চার্চ কলেজে ভর্তি হন | ১৮৭৪ সালে তিনি Wrangler হন | এই পরীক্ষায় তাঁর প্রথম হয়ে Senior Wrangler হওয়ার ইচ্ছা ছিল, এবং সম্ভবত সামর্থ্যও ছিল | কিন্তু সেটি ঘটেনি | তার অন্যতম কারণ এই যে তিনি একই সঙ্গে ব্যারিস্টারী পরীক্ষা দেন, এবং ব্যারিস্টার হন | পরবর্তী জীবনে আনন্দমোহন অবশ্য গণিত-চর্চা বা গণিতে অধ্যাপনা করেননি -- তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন |
শিক্ষা-বিস্তারে আনন্দমোহনের বিশেষ উত্সাহ ও অবদান ছিল | তিনি নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি এই উদ্দেশে দান করেন | এটি এখনকার সিটি স্কুল | তাঁর শিক্ষা-বিস্তারের এই উদ্যোগের ফলশ্রুতি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ | এটি প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তাগাছার মহারাজা শশীকান্ত, রামগোপালপুরের জগকিশোর রায়চৌধুরী, সন্তোষের জমিদার রানী দিনমণি, মুক্তাগাছার জগত-কিশোর আচার্য্য, সন্তোষের প্রমথনাথ চৌধুরী, পুঁটিয়ার হেমন্তকুমারী দেবী এবং ভবানীপুর জমিদার-পত্নী রামসুন্দর দেবী অর্থ-সাহায্য দিয়েছিলেন |
আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর বোনের সঙ্গে আনন্দমোহনের বিয়ে হয় | তিনি কেশব চন্দ্র সেনের কাছে সস্ত্রীক ব্রাহ্ম-ধর্মে দীক্ষিত হন | ১৮৭৮ সালে তিনি সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন | তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি |
বঙ্গ-ভঙ্গ রোধের জন্য যে সম্মেলন হয়, অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করেন, এবং সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্ব শায়িত অবস্থায় পালন করেন | সেদিন তার রচিত প্রতিষ্ঠা-পত্র রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শুনিয়েছিলেন | বিলাতে বা ইউরোপ, আমেরিকার মত উন্নত কোনো দেশে না গিয়ে এবং সেখানকার পন্ডিতদের সহায়তা না নিয়ে ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে একান্ত নিজের মেধায় ও শক্তিতে বিশ্ব-গণিতের সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন যে উজ্জ্বল প্রতিভা, তাঁর নাম আশুতোষ মুখোপাধ্যায় | ১৮৬৪ সালে ১৮ জুন কলকাতায় এই মনীষীর জন্ম | ইনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় ও এফ. এ. তে তৃতীয় হন| এফ. এ. পরীক্ষার সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন | এফ. এ. অধ্যয়নকালে ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (আচার্য্য), হেরম্ব মৈত্র, নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ) তাঁর সহপাঠী ছিলেন | তিনি বি. এ. পরীক্ষায় এ. কোর্স ও বি. কোর্স দুভাগ মিলিয়ে প্রথম হন এবং গণিতে এম. এ. পরীক্ষায়ও প্রথম হন | এর পরের বছর আশুতোষ গণিতে প্রেম চাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি পরীক্ষা ও বিজ্ঞানে এম. এ. পাশ করেন | প্রেম চাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বর এবং বিজ্ঞানে শতকরা ছিয়ানব্বই নম্বর পান | এই কৃতিত্বের জন্যে পরের বছরই তাঁকে গণিতের পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় | ১৮৮৮ সালে আশুতোষ ল (Law) পরীক্ষায় পাশ করেন এবং তার ছয় বছর পরে ডক্টর অফ ল ডিগ্রী অর্জন করেন | কিছু কালের জন্য তিনি Tagore Law Professor ছিলেন | আনন্দমোহন বোস তাঁর অন্যতম আইনের শিক্ষক ছিলেন | তাঁর মাত্র ষোলো বছর বয়েসের সময় Cambridge Messenger of Mathematics -এ তাঁর গণিতের প্রবন্ধ ছাপা হয় | এর পর ১০ বছরে এক এক করে তিনি কুড়িটি প্রবন্ধ লেখেন -- দেশের ও বিদেশের পত্রিকায় এগুলি ছাপা হয় | তখনকার দিনে বিলেতে যাবার ব্যাপারে হিন্দুদের মধ্যে নানারকম কুসংস্কার ছিল | এর ফলে, মায়ের আপত্তির কারণে আশুতোষের বিলাতে বা অন্যত্র উচ্চ-শিক্ষা বা গবেষণার জন্য যাওয়া হয়নি | তাই তাঁর সব গবেষণা ও আবিষ্কার দেশে বসে নিজে নিজেই করা | ১৮৮৪ সালে কলকাতার Journal of the Asiatic Society তে প্রকাশিত তাঁর একটি গবেষণাপত্র সম্পর্কে Joseph Edwards এর Differential Calculus বিষয়ক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে মন্তব্য আছে যে, বিখ্যাত গণিতবিদ Monge জ্যামিতির General Conic এর সমীকরণ থেকে সব কটি সহগ অপসারণের মাধ্যমে একটি Differential Equation পেয়েছিলেন | পৃথিবীবিখ্যাত গণিতবিদ এবং তত্কালীন London Mathematical Society র সভাপতি George Boole এই Differential Equation এর কোনো জ্যামিতিক তাত্পর্য খুঁজে পাননি | এবং পাওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন |এই Boole-এর নামে পরিচিত Boolean Algebra প্রায় সবার জ্ঞাত | আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে এই Differential Equation টি জ্যামিতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ | তিনি এর তাত্পর্য-ও পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেছিলেন |
১৮৮৬ সালে বৃটেনের Quarterly Journal of Mathematics - এ আশুতোষের গবেষণা প্রবন্ধ ``A note on Elliptic Functions'' সম্বন্ধে বৃটেনের বিখ্যাত গণিতবিদ Cayley মন্তব্য করেন ``It is remarkable how in the forgoing investigation a real result is obtained by consideration of an imaginary point."
Enneper - Muller এর জার্মান বই Elliptichen Functionen এবং Broit et Broquet এর ফরাসী বই Functiones Ellipteques থেকে আশুতোষ elliptic function সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন | তিনি ফরাসী, জার্মান ও ল্যাটিন ভাষা ভালো ভাবে শিখেছিলেন | মাত্র ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত আশুতোষ গণিতের গবেষণা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন | বিদেশে না গিয়েও এই গবেষনার মাহাত্ম্যে তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানসমিতি Cambridge Philosophical Society-র Fellow নির্বাচিত হন | গণিতে গবেষণা ও অধ্যাপনা আশুতোষের আকাঙ্ক্ষা ছিল | শিক্ষাবিভাগের অধিকর্তা Alfred Croftতাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার জন্য আহ্বান করলেন | কিন্তু ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান মর্যাদা পাবেননা জেনে তিনি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন |
তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং ১৬ বছর পরে ১৯০৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন | আইনব্যবসা কালে তাঁর আয় মাসে দশ হাজার টাকা ছিল, এখন তাঁর আয় দাঁড়ালো মাসে তিন হাজার | কিন্তু আয় কমলেও অবসর সময়ে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে পারবেন বলে তিনি এই বিচারপতির কাজটিই বেছে নিলেন | তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর | ঊনিশ বছর হাই কোর্টের বিচারপতি ছিলেন এবং ১৯২০ সালে কিছু দিনের জন্য প্রধান বিচারপতি ছিলেন | ১৯০৮ সালে আশুতোষ প্রথমবারের মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন | দু বছর করে আট বছর উপাচার্য ছিলেন | একই সঙ্গে হাই কোর্টের বিচারপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দুটি পদ-ই তিনি অলংকৃত করে ছিলেন -- উপাচার্যের পদটি অবৈতনিক ছিল |
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পান্ডিত্য ও বহুমুখী গুণবত্তার জন্য `নাইট' উপাধি দিয়েছিলেন | নবদ্বীপের পন্ডিত-সমাজ তাঁকে `সরস্বতী' উপাধি এবং ঢাকার পন্ডিত-সমাজ তাঁকে `শাস্ত্র-বাচস্পতি' উপাধি প্রদান করেন | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষার পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করে পালি ভাষার প্রতি তিনি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন তাঁর জন্য সিংহলের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা তাঁকে `সম্বুদ্ধাগম চক্রবর্তী' উপাধি দেন | আশুতোষ গণিত-বিষয়ে আলোচনা, গবেষণা ও তার প্রকাশনার জন্য ১৯০৮ সালে Calcutta Mathematical Society প্রতিষ্ঠা করেন | তখন কলকাতা অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল | ব্রিটেনে জাতীয় গণিত-সমিতির নাম London Mathematical Society। উনিও জাতীয় গণিত-সমিতি হিসাবে উপরি-উক্ত নামে এই সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন | Calcutta Mathematical Society-র সুনাম বিশ্বব্যাপী ছিল ও আছে | প্রফেসর এস. কে. মিত্র. ১৯৯৪ সালে এই সোসাইটির ৮৬-তম বর্ষ-পূর্তি অনুষ্ঠানে Guest of Honour হিসাবে বক্তৃতায় বলেন যে, U.S.A.-তে ত্রিশের দশকে স্থাপিত Institute of Advanced Studies (Princeton)-এ তিনি Bulletin of Calcutta Mathematical Society-র full set দেখেছেন | আবার, Cambridge University-তেও ওই bulletin শুরুর বছর থেকে আছে | এ-দুটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলির অন্যতম |
ছাত্র অবস্থা থেকেই আশুতোষ অনেক বই কিনতেন এবং পড়তেন | প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রাবস্থায় James Clerk Maxwell - এর Electricity and Magnetism Vol. Iও II তে প্রকাশিত Maxwell -এর সদ্য আবিষ্কৃত তত্ত্ব আশুতোষ পড়েছিলেন | কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল | তাঁর শিক্ষক Dr. Bruhe-ও এই বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করতে পারলেন না | পরে ওই তত্ত্ব-সংক্রান্ত Henri Poincare - র বই পড়ে বিষয়টি আত্মস্থ করেন | এত অল্প বয়সে আধুনিকতম তত্ত্ব জানার ও বোঝার আগ্রহ ও ক্ষমতার এই পরিচয়ে বিস্মিত হতে হয় |
আশুতোষের প্রায় পঁচাত্তর হাজার বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন ভাষার মূল্যবান বই ছিল | এগুলি তাঁর উত্তরাধিকারীরা কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিকে দান করেছেন | আশুতোষ সংগ্রহশালা (Ashutosh Collection ) নামে ওই লাইব্রেরির একটি বিশেষ অংশ জুড়ে আছে এই বইগুলি | পৃথিবী-বিখ্যাত গণিতবিদদের রচিত অনেক বই এর মধ্যে আছে | John Bolyai, Alfred Clebsh, Edward Dickson, O. L. Coolidge, Rene Descartes, Gespard De Monge, George Salmon, David Hilbert, A. M. Legendre, Isaac Barrow, D. E. Smith, K. F. Gauss, D. M. Sommerville, N. I. Lobacheffsky, F. Klein, I. Newton, Leonard Euler প্রমুখ | তাঁর সংগ্রহে ইউক্লিডের ত্রিশটি জ্যামিতি-বিষয়ক বই ছিল, যার মধ্যে ১৫৭০ সালে Billingsley-কৃত ইউক্লিডের বিখ্যাত বই `Elements' - এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদও ছিল |
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা ছিল | অধ্যাপনার ব্যবস্থা শুধু কলেজে ছিল | এম. এ. প্রেসিডেন্সি এবং আর মাত্র দু-একটি কলেজে পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল | আশুতোষ উপলব্ধি করেন, এ-দেশে যথার্থ উচ্চ-শিক্ষা ও গবেষনার ব্যবস্থা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপন্ডিত ও অত্যন্ত মেধাবী দেশী শিক্ষকের সমাবেশ ঘটিয়ে তাঁদের অধ্যাপক নিয়োগ করা প্রয়োজন, এবং তাঁদের পাঠ-দানের উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরী করা প্রয়োজন | এই গুরুদায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে সক্ষম হন | শিক্ষা-বিভাগে ইংরেজ কর্মকর্তাদের প্রচন্ড প্রতিকূলতা-কে তাঁর বাগ্মিতা, দৃঢ় মনোবল ও ওজস্বিতার সাহায্যে প্রতিহত ক'রে, নিজের বহুমুখী পান্ডিত্য ও তীক্ষ্ণ মেধার ঐশ্বর্য্য ব্যবহার করে, এবং দেশের ও জাতির উন্নতির জন্য তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছার জোরে প্রত্যেক বিষয়ে যোগ্যতম শিক্ষক নিয়োগদান করেন | এইভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের মানচিত্রে অনেক সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন | তাঁর উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্য-শিক্ষার ব্যবস্থা হয় | সমস্ত ভারতবাসী, বিশেষ করে বাঙালীর কাছে তাঁর ঋণ তাই অপরিশোধ্য | শিক্ষক-নিয়োগে তাঁর অসাধারণ নির্বাচন-দক্ষতার একটি উদাহরণ দিই | গণিতে সবে এম. এ. পাশ করা সত্যেন বোস ও মেঘনাদ সাহার প্রত্যেককে তিনি এম. এ. ক্লাসে গণিত ও পদার্থবিদ্যা পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন | তাঁরা পুরানো সনাতন বিষয়গুলি পরানো ছাড়াও সদ্য-সৃষ্ট ও নির্মীয়মান যুগান্তকারী Relativity ও Quantum Theory -র তত্ত্বগুলি পড়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর অঙ্গীকার করলেন ও সেইমত পড়ালেন | কয়েক বছরের মধ্যে এইসব বিষয়ে নিজেরাও গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত হয়ে নিজেদের ও আশুতোষের যোগ্যতার প্রমান দিলেন | এইভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাতারে শামিল হলো |
আশুতোষ অত্যন্ত নির্ভীক ও তেজী পুরুষ ছিলেন | এ সম্বন্ধে তিনটি ঘটনার উল্লেখ করে ওঁর প্রসঙ্গ শেষ করছি | প্রথম ঘটনাটি আমার শ্রদ্ধেয় একজনের মুখে শোনা -- এই ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য গণিত-দক্ষতারও দৃষ্টান্ত মেলে |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কাজে শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসাবে আশুতোষ ঢাকায় গিয়েছিলেন | তখন ঢাকা কলেজে একজন ইংরেজ গণিত-অধ্যাপক দেশী ছাত্রদের হেয় ও তাচ্ছিল্য করতেন এবং রূঢ় আচরণ করতেন | ছাত্ররা আশুতোষের কাছে এই বিষয়ে নালিশ করেছিল | উনি তাঁদের বকে দিলেন, শিক্ষকের মর্যাদার রক্ষার কথা মনে করিয়ে দিয়ে | এর পর এক দিন ওই অধ্যাপকের ক্লাস চলার সময় তিনি ও তাঁর অন্যান্য সদস্যরা ওই ক্লাসে উপস্থিত থাকলেন | অধ্যাপক পড়ানোর সময় কোনো একটি অঙ্কের সমস্যা বোর্ডে সমাধান করলেন | আশুতোষ ক্লাসের ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, কত জন বুঝেছে | দেখা গেল, বেশির ভাগ ছাত্রই সমাধানটি বোঝেনি | তখন উনি শিক্ষকটিকে অন্য পদ্ধতিতে অঙ্কটির সমাধান করতে বল্লেন | শিক্ষক আরেকটি সমাধান দিলে, তারপরও দেখা গেল, অনেকেই বোঝেনি | তখন উনি শিক্ষকটিকে আরো অন্য পদ্ধতি চেষ্টা করতে বল্লেন | শিক্ষকটি না পেরে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন | তখন আশুতোষ নিজে বোর্ডে গিয়ে একের পর এক মোট দশ রকম পদ্ধতিতে অঙ্কটি সমাধান করলেন, এবং শেষকালে দেখা গেল, প্রত্যেক ছাত্রই তা বুঝেছে | শিক্ষকটির অবস্থা তখন কাহিল !
একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে আশুতোষ আলীগড় গিয়েছিলেন | ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় কলকাতায় ফিরছেন | ওই কামরায় এক ইংরেজ মিলিটারী অফিসার ছিলেন | এক সময় আশুতোষের তন্দ্রা এসে যায় | জেগে দেখেন, তাঁর চটি-জোড়া নেই | অর্থাত্, সাহেব ফেলে দিয়েছেন | পরে সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে তিনি সাহেবের খুলে-রাখা কোট বাইরে ফেলে দিলেন | সাহেব জেগে উঠে কোট খুঁজছেন | আশুতোষকে জিজ্ঞাসা করলে উনি বললেন, `তোমার কোট আমার জুতো আনতে গেছে' |
১৯২৩ সালে সরকারের বশংবদ হয়ে থাকার শর্ত মেনে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার প্রস্তাব করা হয় | উনি শুধু ঘৃনাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানই করলেননা, খবরের কাগজে সব কিছু প্রকাশ করে জন-সমক্ষে বিষয়টি তুলে ধরলেন |
তাঁর এই অসামান্য তেজের জন্য তাঁকে `বাংলার বাঘ' বলা হয় |
১৮৬৬ সালে চট্টগ্রামে এক গণিত-প্রতিভার জন্ম হয় | তাঁর নাম অপূর্ব চন্দ্র দত্ত | কারো কারো লেখায় তাঁকে Wrangler বলে উল্লেখ করা হয়েছে | কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ডিগ্রীতে লেখা আছে `Senior Optime' | এর অর্থ, সামান্য কিছু নম্বরের জন্য তিনি Wrangler হতে পারেননি | তাঁকে তাই `প্রায়-Wrangler ' বলা যায় | তাঁর বিষয়ে এরকম আরেকটি জনশ্রুতি পরে ভ্রান্ত প্রমানিত হয়েছে | সাধারণ ভাবে জানা যায় যে তিনি Royal Astronomical Society-র Fellow ছিলেন, আবার Royal Meteorological Society-রও Fellow ছিলেন | কিন্তু তাঁর Royal Meteorological Society-র Fellowship অভ্রান্ত হলেও Royal Meteorological Society-র তিনি Fellow ছিলেননা | Astronomy -তে তাঁর অবশ্য গভীর পান্ডিত্য ছিল, এবং `জ্যোতিষ-দর্পণ' নামে তিনি একটি বই রচনা করেন | Meteorology বিষয়ে তাঁর অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় | গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে তাঁর গভীর উত্সাহ ও প্রগাঢ় পান্ডিত্য ছিল | ইংরেজি, ফরাসী ও ল্যাটিন ভাষায় বিশ্ব-বিখ্যাত মনীষীদের লেখা অনেক বই তাঁর সংগ্রহে ছিল | তাঁর উত্তরাধিকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর অনেক মূল্যবান বই উপহার দিয়েছেন | এর মধ্যে Kepler -এর Astronomia Nova (১৬০৯), Tycho Brahe-র প্রস্তুতকৃত গ্রহ-তারা সম্পর্কিত table থেকে Kepler -এর রচিত Tabulae Rudolphinae , গ্রেগরি-র The Elements of Physical and Geometrical Astronomy (যার সঙ্গে Halley-র ১৭২৬ সালে দুই খন্ডে প্রকাশিত Synopsis of Astronomy of Comets-ও সংযুক্ত ছিল), U-J.Le Verriere -এর Developments sur plusieurs points dela Theorie des Planets (১৮৪২), Researches sur les movement de les Planet Hershel (১৮৪৬) ও Bessel -এর Tabulea Regtomontanae (১৮৩০) রয়েছে |
অপূর্ব চন্দ্র দত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা ও প্রশাসনে নিযুক্ত ছিলেন | সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজে তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন |
এবার একজনের কথা লিখব, তিনি Senior Wrangler হয়ে ছিলেন | এ. সি. ব্যানার্জি. ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করেন | এর পর কেমব্রিজে Clare College- এ ১৯১৫-১৯১৯ সময়কালে Senior Wrangler হন এবং দুর্লভ Owst Prize অর্জন করেন| তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী Eddington, Chapman, Larmor ও C. T. R. Wilson-এর কাছে Cavendish Laboratory- তে গবেষণা করেন | তাঁর প্রথম গবেষণা-কর্মটির নাম `The Instability of Radial Oscillations of a Variable Star and Origin of Solar System' | এটি সৌরজগতের সৃষ্টি সম্পর্কিত একটি তত্ত্ব | Sir James Jeans-এর এই বিষয়ক তত্ত্বের সঙ্গে এটির মিল এবং অমিল দুই-ই আছে | এ. সি. ব্যানার্জির তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক-মহলে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল | প্রফেসর ব্যানার্জি পরে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে এলাহাবাদে অনেক যৌথ গবেষণা করেন | এছাড়া Astrophysics -এ নিজামুদ্দীন ও ভাটনগরের সঙ্গে তাঁর ভালো ভালো গবেষণা-প্রবন্ধ আছে | এ. সি. ব্যানার্জির বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-এর সমসাময়িক এবং কলেজের সহপাঠী বন্ধু ছিলেন |
এবার তিন অসাধারণ প্রতিভার সম্বন্ধে সংক্ষেপে এক সঙ্গে আলোচনা করব | এঁরা প্রায়-সমসাময়িক এবং পরস্পর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন | এক সঙ্গে কাজ-ও করেছেন | তিনজনেই F. R. S. হয়েছিলেন এবং তিনজনই বিশ্ববিখ্যাত | এঁরা মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬), প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩-১৯৭২) এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) | এর মধ্যে প্রথম দুজনের বাড়ি তত্কালীন ঢাকা জেলায় এবং শেষজনের বাড়ি কলকাতায় | সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা সহপাঠী এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন | ১৯১৩ সালে গণিতে অনার্স, এবং ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে এম. এ. | এ দুটি পরীক্ষাতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম এবং মেঘনাদ দ্বিতীয় হন | ওঁদের এম. এ. পরীক্ষার কিছু আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশী প্রফেসর নিয়োগের কর্মসূচীর আওতায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গনেশপ্রসাদ নামে একজন মহাপন্ডিত জ্ঞান-তাপসকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের দায়িত্ব দেন | তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম গণিতজ্ঞদের অন্যতম জার্মান গণিতজ্ঞ Felix Klein -এর কাছে গবেষণা করেছিলেন | তাঁর প্রশ্নপত্র অত্যন্ত কঠিন এবং অনেক নতুন গাণিতিক শব্দ ও বিষয় সমন্বিত থাকায়, এই পরীক্ষায় অনেক ভালো ছাত্রেরও বেশ অসুবিধা হয়েছিল | তবে সত্যেন্দ্রনাথকে, এবং সম্ভবত মেঘনাদকেও, এই প্রশ্ন অসুবিধায় ফেলতে পারেনি | কারণ, এ-সত্ত্বেও, সত্যেন্দ্রনাথ মিশ্র গণিতে এম. এ. পরীক্ষায় শতকরা ৯২ নম্বর পেয়ে প্রথম হন | এইটি এখনো পর্যন্ত রেকর্ড নম্বর | প্রশান্তচন্দ্র কলকাতা থেকে অনার্স পাশ করে কেমব্রিজে পড়তে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হন | এঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ পদার্থবিদ হিসাবে এবং প্রশান্তচন্দ্র পরিসংখ্যানবিদ হিসাবে বিশ্ববিখ্যাত হন | তবে, গণিত এঁদের প্রায় সব গবেষণা-কাজে মূল শক্তি ছিল |
মেঘনাদ সাহা এম. এ. পাশ করার পরপরই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ পরীক্ষা পাশ করেন এবং ভালো গবেষণা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেন | সেই সময় নির্মীয়মান কোয়ান্টাম তত্ত্ব, বিশেষ করে Max Planck ও Niels Bohr -এর গবেষণা-লব্ধ ফল ব্যবহার করে তারার ঔজ্জ্বল্য ও তাপমাত্রা সম্পর্কিত তাঁর গবেষণা তাঁকে বিশ্বখ্যাতি দান করে এবং তিনি খুব অল্প বয়সে F. R. S. হন | পরে তিনি দেশে-বিদেশে এই বিষয়ে এবং তাত্ত্বিক পদার্থ-বিদ্যার অন্যান্য বিষয়ে অনেক উচ্চমানের গবেষণা করেন | Astrophysics-এ মেঘনাদ সাহার তত্ত্ব ওই বিষয়ে প্রথমদিককার মৌলিক গুরুত্ত্বপূর্ণ তত্ত্বের অন্যতম | গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আর্থিক অসচ্ছলতা ও তত্কালীন সামাজিক প্রতিকুলতা সত্ত্বেও তিনি তীক্ষ্ণ মেধা ও কঠোর সাধনার জোরে বিশ্ব-বরেণ্য হয়ে শুধু নিজের নয়, বাংলা, তথা সমগ্র উপমহাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন | তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত Saha Institute ভারতের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান |
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কেমব্রিজে J. J. Thompson বা ওই মাপের বড় পদার্থবিদের সঙ্গে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য গবেষণা করার কথা স্থির হয়েছিল | কিন্তু অনার্স পাশ করে দেশে বেড়াতে এসে প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে তখন তাঁর বিলাতে ফেরা হলো না | তাই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যপনা শুরু করেন | ওই অবস্থায় কলকাতার ওই কলেজেই তাঁর পরিসংখ্যান বিষয়ে গবেষণা শুরু হয় | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফলাফল, ভারতীয় Geological Survey -র তথ্যাদি ইত্যাদি নিয়ে তাঁর গবেষণার সূত্রপাত | যেকজন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির গবেষণা মূল পরিসংখ্যান বিষয়ের ভিত্তি, প্রশান্তচন্দ্রর গবেষণা তার অন্যতম | নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি -- এসব বিষয়েও তাঁর গভীর দখল ছিল এবং এইসব নিয়ে তাঁর ভালো গবেষণা-কাজ আছে | তিনি ১৯৪৫ সালে F. R. S. হন | প্রশান্তচন্দ্রর একটি বিশাল কীর্তি Indian Statistical Institute প্রতিষ্ঠা করা | প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগে কর্মরত অবস্থায় তাঁর প্রভূত গবেষণার মাধ্যমে সেখানেই এই Institute - এর গড়া-পত্তন হলেও প্রশান্তচন্দ্র কলকাতার বরানগরে নিজের সম্পত্তির একটি বিরাট ভূখন্ডে এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেন -- এরই চত্তরের মাঝখানে প্রশান্তচন্দ্রের নিজের বাড়ি (রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত নাম, `আম্রপালী') | এইটি এখন তাঁর স্মৃতিবাহী সৌধ (museum) | ভারতের আরো কয়েকটি শহরে এই Institute - এর শাখা আছে | পরিসংখ্যানকে কেন্দ্র করে এই Institute - এ অনেক বিষয়ে খুব উচ্চ-মানের পঠন-পাঠন ও গবেষণা হয় | এটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিসংখ্যান শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র | এখানকার প্রাক্তন শিক্ষক, গবেষক, গবেষণা-পরিচালক এবং Institute -এর প্রাক্তন পরিচালক Professor C. R. Rao একজন F. R. S. এবং বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পরিসংখ্যানবিদদের অন্যতম | কলকাতার এই Institute -এ Prof. Rao -এর তত্ত্বাবধানে Ph. D-করা Professor Vardhan U.S.A-র বিখ্যাত Courant Institute -এর পরিচালক, যিনি গণিতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার (Abel পুরস্কার) অর্জন করেছেন |
সত্যেন্দ্রনাথ এম. এ. পাশ করার পর প্রথমদিকে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে কিছু ভালো গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশ করেন | Einstein-এর General Relativity তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পরে ১৯১৯ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে এই তত্ত্বের সত্যতা নির্ধারিত হয় | এর ফলে, নিউটনীয় মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বের তুলনায় এই তত্ত্বের শ্রেষ্ঠত্ব সুস্পষ্ট ভাবে প্রমান হয় এবং বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয় | তখন মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞানী এ তত্ত্ব বুঝতেন | এসময় ১৯২০ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ Special ও General Relativity তত্ত্বের মূল তিনটি জার্মান গবেষণা-প্রবন্ধ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, এবং প্রশান্তচন্দ্রের অত্যন্ত সুলিখিত একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা সহ এগুলি একটি বই আকারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় | Einstein ও Minkowski -র ওই গবেষণা প্রবন্ধ গুলি এই প্রথম ইংরেজিতে অনূদিত হলো | সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ ১৯১৬ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যপনা শুরু করেন -- পদার্থবিদ্যা বিভাগেরও এই সূচনা | এঁরা দুজনে নবীন হলেও পুরানো বিষয়গুলির সঙ্গেসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর পদার্থ-বিজ্ঞানের দুটি স্তম্ভ Relativity ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিতে এঁরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, নিজেরাও এই সব বিষয়ে গবেষণায় সচেষ্ট ছিলেন | তাঁরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতেরও শিক্ষক ছিলেন | ১৯২১ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন এবং মেঘনাদ কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন | ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সত্যেন্দ্রনাথের একটি গবেষণা-প্রবন্ধ Einstein-এর উদ্যোগে জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয় | এর বিষয়বস্তু Bose-Einstein Statistics বা Bose-Statistics নামে খ্যাত | এই প্রবন্ধ তাঁর বিশ্বখ্যাতির উত্স | ইলেকট্রন, প্রোটন ইত্যাদি যথা মৌলিক কনিকা বিশ্বব্রহ্মান্ডে বিরাজমান, তাদের দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ; boson (সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে) এবং fermion (ইতালীয় বৈজ্ঞানিক Enrico ফের্মি -র নামে) | এই দুই রকম ছাড়া অন্য কোনো ধরনের মৌলিক কণিকার অস্তিত্ব নেই | এ থেকে সত্যেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি | ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে সত্যেন্দ্রনাথ আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন | ঢাকা এবং কলকাতায় উনি পদার্থবিদ্যায় একইসঙ্গে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষাগার ভিত্তিক কয়েকটি বিষয়ে গবেষণা করেন | ১৯২৪-২৫ সময়কালে উনি আর্থিক আনুকুল্য সহ ইউরোপে শিক্ষা-সফরের সুযোগ পান | তখন তিনি Einstein , মাদাম ক্যুরি, Louis de Broglie প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে মিলিত হন, এবং এঁদের অনেকের পরীক্ষাগার এবং পরীক্ষা-পদ্ধতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জেনে দেশে কিছু কিছু নতুন প্রয়োজনীয় যন্ত্র নিজে উদ্ভাবন করে ও প্রস্তুত করিয়ে পরীক্ষাগারে স্থাপন করেন | তাঁর ছাত্রেরা ওই যন্ত্রের সাহায্যে গবেষণা করেছেন | রসায়ন-শাস্ত্র সম্বদ্ধে তাঁর জ্ঞান গভীর ছিল এবং এই বিষয়েও তিনি গবেষণা পরিচালনা করতেন | ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণের অব্যবহিত আগে Einstein-এর Unified Field Theory বিষয়ে তাঁর চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-প্রবন্ধ U.S.A. ও ফ্রান্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় | ১৯৫৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ F. R. S. হন | ত্রিশ-চল্লিশের দশকে প্রশান্তচন্দ্রের পরিসংখ্যান বিষয়ক তত্ত্বের সম্পৃক্ত কয়েকটি বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন | তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় ও পরিসংখ্যানের সত্যেন্দ্রনাথের কাজ তাঁর গভীর গণিত-জ্ঞান ও গণিত-ব্যবহারের অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচায়ক | শেষ বয়েসে তিনি প্রথমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন | পরে তাঁকে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয় | সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ভারত সরকার কলকাতায় তাঁর নামে একটি উচ্চমানের Research Institute প্রতিষ্ঠা করেছেন |
মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু, তিন জনই ভালো বাংলা লিখতে পারতেন এবং বাংলায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞানের অনেক বিষয় খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন | তাঁদের রচিত বাংলা বইও আছে |
গণিতে অসাধারণ ব্যুত্পত্তি ও দক্ষতার অধিকারী এই তিন মনীষীর ত্রিবেণী-সঙ্গম গণিত-ভিত্তিক বিজ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলাকে বিশ্বসভায় সম্মানের আসনে বসিয়েছে | এঁদের সহগামী ও অনুগামী আরো গণিত-প্রতিভা আছেন | তাঁদের কথা আমরা বিস্মৃত হইনি, তবে এখানে তাঁদের সম্বন্ধে আলোচনা করছি না |
তথ্য-সূত্র
১. স্বপন ধর, `উপমহাদেশের প্রথম রাংলার ময়মনসিংহের আনন্দমোহন বসু, ব্রহ্মশৈলীর গবেষণা-পত্র চিরকুট (আনন্দমোহন কলেজ সংখ্যা), ৩০ জানুয়ারী ২০১০, পৃঃ ৪৯ |
২. আশরাফুল ইসলাম, রাংলার আনন্দমোহন বসু : স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ', প্রাগুক্ত, পৃঃ |
৩. রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী, আশুতোষ, প্যাপিরাস, আগস্ট ২০০২ |
৪. Sailesh Dasgupta, `The mathematical contributions of Sir Ashutosh Mukhopadhyay', News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 13, No. 1, Jan. 1990.
৫. S. K. Mitra, Speech of the Guest of Honour on the 86th foundation day anniversary of the Calcutta Mathematical Society, News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 17, No. 10, Oct. 1994.
৬. K. Venkatachaliengar, `On a paper of Ashutosh Mukhopadhyaya', News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 13, No. 6, June 1990.
৭. Manibur Rahman Chowdhury, `Apurba Chandra Dutta and ``Jyotish Darpan''',J. Asiatic Soc. (Kolkata), Vol. 47, No. 1, 2005, pp. 87-92.
৮. H. C. Khare, `Scientific Contributions of Professor A. C. Banerjee (1891-1968)', News Bull. Cal. Math. Soc., Vol. 13, No. 12, Dec. 1990, pp. 1-5.
৯. জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি (জে. বি. এস. হলডেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ), কলকাতা পুরসভা, ১৯৯৪ |
(This article was published in `Banga, Bangla, Bangladesh' - a collection of articles, Bangladesh, 2010.)